জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থান দমনে ড্রোনের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের অবস্থান নির্ণয়, হেলিকপ্টার থেকে বোম্বিং করা, গুলিবর্ষণ, লেথাল উইপন (মারণাস্ত্র) ব্যবহার করতে শেখ হাসিনার দেওয়া এসব নির্দেশনার তথ্য উঠে এসেছে তারই ফোনালাপে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি এ কে এম মাকসুদ কামাল ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে শেখ হাসিনার কথোপকথনের চারটি অডিও ক্লিপে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। কথোপকথনে উঠে এসেছে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের রাজাকার ট্যাগ দিয়ে ফাঁসি দেওয়া, ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করা, আগুন লাগানোর নির্দেশসহ জঙ্গি ট্যাগ দিয়ে প্রপাগান্ডা ছড়ানোর কথাও। ইনুর সঙ্গে কথোপকথনের একপর্যায়ে শেখ হাসিনা তাকে জানান, ‘হেলিকপ্টার থেকে ছত্রীসেনা (প্যারাট্রুপার) নামাচ্ছি’।
গতকাল জবানবন্দি দেওয়ার সময় এই কথোপকথনের অডিও ক্লিপ ট্রাইব্যুনালে শোনান এ মামলার ট্রাইব্যুনালের বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা ও প্রসিকিউটর তানভীর হাসান জোহা।
শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রসিকিউশনের ৫৩তম সাক্ষী হিসেবে বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-১ এ জবানবন্দি দেন তিনি। তার এই জবানবন্দি ট্রাইব্যুনালের অনুমতি নিয়ে সরাসরি সম্প্রচার করা হয় বাংলাদেশ টেলিভিশন, বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন ও চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে। পরে তাকে জেরা করেন পলাতক দুই আসামির পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন।
এ সময় প্রসিকিউশনের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম, গাজী এম এইচ তামীম, বি এম সুলতান মাহমুদ, আবদুস সাত্তার পালোয়ান প্রমুখ। পরে এ মামলার পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আগামী রবিবার দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল। প্রসিকিউশন জানান, ওই দিন মামলার শেষ সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তার জবানবন্দি গ্রহণ শুরু হবে।
জবানবন্দিতে বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা তানভীর হাসান জোহা বলেন, ‘তদন্তকালে আমি বিটিআরসি, এনটিএমসি, ডিএমপিসহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তর থেকে বিভিন্ন অডিও ক্লিপ, ভিডিও ফুটেজ, সিডিআর, আইপিডিআর, সিসি ক্যামেরা ফুটেজসহ ডিজিটাল ফরেনসিক বিষয় বিধি মোতাবেক বিভিন্ন আলামত সংগ্রহের কাজ শুরু করি। এরই ধারাবাহিকতায় গত বছর ২৩ ডিসেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফোনালাপের ৬৯টি অডিও ক্লিপ এবং ৩টি মোবাইল নম্বরের সিডিআর এনটিএমসির (ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার) সহকারী ইঞ্জিনিয়ার এবং প্রশিক্ষক সাদি মোহাম্মদ রিফাতের উপস্থাপন মতে বিধি মোতাবেক জব্দ করি।’
জব্দকৃত অডিও ক্লিপগুলো সিআইডির ফরেনসিক শাখা থেকে পরীক্ষার পর মতামত নেওয়ার কথা জানিয়ে জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘ফোনালাপ সমূহ পর্যালোচনা করে দেখা যায় গত ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে শেখ হাসিনা লেথাল উইপন ব্যবহার করে সরাসরি গুলির নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি ড্রোনের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের অবস্থান নির্ণয়পূর্বক হেলিকপ্টার থেকে বোম্বিং করা, ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করাসহ আন্দোলনকারীদের রাজাকার হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের ফাঁসি দেওয়ার কথা বলেছেন। তারা ফোনালাপে ইংল্যান্ডের উদাহরণ দিয়ে আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের দমন করতে বলেছেন।’ পরে ফোনালাপগুলো ট্রাইব্যুনালে বাজিয়ে শোনান এ বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা। জবানবন্দি শেষে প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম প্রেস ব্রিফিংয়ে এসে এ বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, ফোনালাপে শেখ হাসিনা নিজেই আগুন দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
একই সঙ্গে দায় আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর চাপাতে চেয়েছেন। মিজানুল ইসলাম বলেন, শেখ হাসিনা বলেছেন- ‘আমি বললাম একটা জিনিস পোড়াতে, (যা যা পোড়াতে..) ওরা পুড়িয়ে দিল সেতু ভবন।’ তার মানে আগুন দেওয়ার নির্দেশ উনি দিয়েছেন। কিন্তু উনার কাঙ্ক্ষিত জিনিস না পুড়িয়ে অন্য স্থাপনা পোড়ানো হয়েছে।
ওপেন নির্দেশনা দিয়ে দিসি, এখন লেথাল উইপন ব্যবহার করবে : আন্দোলনকারীরা সচিবালয় আক্রমণ করেছে, ফোনালাপে শেখ হাসিনাকে এমন তথ্য দিতে শোনা যায় শেখ ফজলে নূর তাপসকে। শেখ হাসিনা এই তথ্য জানেন না বললে তাপস বলেন- ‘হ্যাঁ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তো ওইখানে আছে, সচিবালয়ে কয়েকবার ওরা আক্রমণ করছে, ওরা তো রাতে যদি আবার কোথাও কোথাও বিভিন্ন সংবেদনশীল বাসাবাড়িতে আক্রমণ করে তাহলে তো ইয়ে হবে।’ শেখ হাসিনা বলেন- ‘রাতের বেলা সব ভিজিলেন্স থাকবে এবং এই এতদিন তো, আচ্ছা ঠিক আছে আমি এখনই ব্যবস্থা নিচ্ছি। একটু আস্তে আস্তে অনেক জায়গায় গেদারিং ক্লিয়ার হচ্ছে।
তাপস বলেন- ‘ওরা মনে হচ্ছে না ইয়ে করবে, রাতে মনে হয় ওদের আরও অনেক কিছু পরিকল্পনা আছে মনে হচ্ছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তো আমাকে তাই বলল, আভাস দিল এবং আপনাকেও মনে হয় বলছে কিছু যে রাতে যদি সর্বোচ্চ না ইয়ে করে করবেন নাকি? শেখ হাসিনা জিজ্ঞেস করেন- ‘কী করব?’ তাপস বলেন- ‘মানে সেনাবাহিনী দিবেন?’ তখন শেখ হাসিনা বলেন- ‘বাবা, একটু চিন্তা করে কথা কইও। এটাই তাদের আকাঙ্ক্ষা।’ তাপসও তখন সায় দেন শেখ হাসিনার কথায়।
একপর্যায়ে শেখ হাসিনা বলেন- ‘দরকার নাই, ওটা দরকার নাই। আমি সেনাপ্রধানের সাথে কথা বলছি। ওরা রেডি থাকবে ঠিক আছে? এখন তো আমরা অন্য ইয়ে করতেছি। ড্রোন দিয়ে ছবি নিচ্ছি আর হেলিকপ্টারে ইয়ে হচ্ছে মানে কয়েক জায়গায়।’ তখন তাপস বলেন- ‘তাহলে কিছু ছবি দেখে পাকড়াও করা যায় না রাতের মধ্যে? শেখ হাসিনা বলেন- ‘সবগুলিকে অ্যারেস্ট করতে বলেছি রাত্রে।’ তাপস তখন পাকড়াওয়ের কথা বললে শেখ হাসিনা বলেন- ‘ না ওটা বলা হয়ে গেছে, ওটা নিয়ে র্যাব, ডিজিএফআই, এনএসআই সবাইকে বলা হইছে, যে যেখান থেকে যে কয়টা পারবা ধইরা ফেলো।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বরাত দিয়ে তাপস আন্দোলনকারীদের মোহাম্মদপুর থানার দিকে যাওয়ার কথা বললে শেখ হাসিনা র্যাব পাঠানোর কথা বলেন। তখন তাপস বলেন- ‘তাহলে আপনার নির্দেশনা লাগবে।’ এ সময় শেখ হাসিনা বলেন- ‘আমার নির্দেশনা দেওয়া আছে ওপেন নির্দেশনা দিয়ে দিসি। এখন লেথাল উইপন ব্যবহার করবে। যেখানে পাবে সোজা গুলি করবে। ওটা বলা আছে। আমি এতদিন বাধা দিয়ে রাখছিলাম। ওই যে স্টুডেন্টরা ছিল ওদের সেফটির কথা চিন্তা করে, তারপর তো... ’
একপর্যায়ে তাপসকে বলতে শোনা যায়- ‘না রাতে স্টুডেন্ট না, রাতে হলো ওরা সন্ত্রাসী।’ তখন শেখ হাসিনা বলেন- ‘ওই যে আমাদের রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুলের একটা বাচ্চা ছেলে, তার শিক্ষক তাকে ডাইকা নিয়ে আসছে, শিক্ষক নাকি আবার শিবির করত, ওরা জানে না। তারপর সেই ছেলেটা মারা গেছে। তার মাত্র বুকে একটা গুলি অথচ পুলিশ কিন্তু কোনো রিভলবার ব্যবহার করেনি। এরকম ঘটনা তারা ঘটাইছে।’
এই ফোনকল রেকর্ডেই শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়- ‘সব জায়গায় আগুন, বিআরটি, বিটিআরসি বন্ধ করে দিছে, পোড়াইয়া দিছে, বিটিভি পোড়াইয়া দিছে, এখন তো ইন্টারনেট বন্ধ সব পোড়াইয়া দিছে, এখন চলবে কীভাবে?’ এ সময় তাপস বলেন, ‘জি, এটা ভালো হইছে, জি’। শেখ হাসিনা বলেন, না.. পোড়াইয়া দিছে, মেশিনপত্র সব পুড়ে গেছে। আমি বলছি যা যা পোড়াতে... ও আমাদের সেতু ভবন পোড়াইছে। তাপস বলেন, ‘জি, ওরা রাতে মনে হয় আরও ব্যাপক আক্রমণ করবে। শেখ হাসিনা বলেন, ‘হ্যাঁ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সেটা পোড়াইছে..।’
তাপস বলেন, ‘কারণ এই যে আমি ফিরলাম, আমি দেখলাম যে রাস্তায় রাস্তায় ওরা বিভিন্ন জায়গায় ইয়ে করতেছে’। জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কোন কোন জায়গায়?’ তাপস বলেন, ‘বনানীতে ও বনানী গুলশানে তো সচারচর করে না, কিন্তু বনানী গুলশানে ওরা ইয়েতে চলে আসছে...। কোথাও কোথাও ইয়ে করতে পারে মুভমেন্ট আছে সব জায়গায়।’ তাপসকে উদ্দেশ্য করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ঠিক আছে আমি দেখছি। তোমরা সাবধানে থেকো।’ তাপস বলেন, ‘জি আমি সাবধানে আছি।’
একটাকেও ছাড়ব না : প্রসিকিউশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মাকসুদ কামালের ফোনালাপটি হয় গত বছর ১৪ জুলাই রাত সাড়ে ১১টার দিকে। মাকসুদ কামাল ওই দিন ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি তুলে ধরেন শেখ হাসিনার কাছে। আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছিলেন, প্রত্যেক হল থেকে ছেলেমেয়েরা তালা ভেঙে বের হয়ে গেছে। তার (উপাচার্যের) বাসভবনে হামলা হতে পারে। তখন শেখ হাসিনা তার বাসভবনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেন।
ফোনকল রেকর্ডে মাকসুদ কামালকে বলতে শোনা যায়, ‘ওই রকম একটা প্রস্তুতি... লাঠিসোঁটা নিয়ে বের হইছে।’ তখন শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, ‘লাঠিসোঁটা নিয়ে বের হলে হবে না, আমি পুলিশ এবং বিডিআর বিজিবি আর...বলেছি খুব অ্যালার্ট থাকতে এবং তারা (আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা) রাজাকার হইতে চাইছে তো, তাদের সবাই রাজাকার। কী আশ্চর্য কোন দেশে বসবাস করি!’
মাকসুদ কামাল এ সময় বলেন, জি জি... বলতেছে আমরা সবাই রাজাকার। জবাবে শেখ হাসিনা বলেন- ‘তো রাজাকারের তো ফাঁসি দিসি, এবার তোদেরও তাই করব। একটাকেও ছাড়ব না, আমি বলে দিছি। এই এতদিন ধরে আমরা কিন্তু বলিনি, ধৈর্য ধরছি, তারা আবার বাড়ছে।’
মাকসুদ কামাল শেখ হাসিনার কথায় সমর্থন জানিয়ে বলেন- ‘বেশি বেড়ে গেছে এবং অতিরিক্ত বেড়ে গেছে, অতিরিক্ত..... তো আপা একটু ক্যাম্পাসের নিরাপত্তাটা আরেকটু বাড়ানো... আর আমার বাসার ওইখানেও...’। শেখ হাসিনা বলেন- ‘ক্যাম্পাসের ব্যবস্থা করছি, সমস্ত ক্যাম্পাসে বিজিবি, র্যাব এবং পুলিশ... সব রকম ব্যবস্থা হইছে। তোমার বাসার ভিতরে লোক রাখতে বলছি। ভিতরে কিছু রাখা আছে... এত বাড়াবাড়ি ভালো না।’
‘একাত্তর হলে ছাত্রলীগের ছেলেদেরকে মেরেছে’ মাকসুদ কামাল ফোনালাপে এমন তথ্য দিলে শেখ হাসিনা বলেন- ‘কোন দেশে বাস করি আমরা! এদেরকে বাড়তে বাড়তে তো... রাজাকারদের কী অবস্থা হয়েছে দেখিস নাই, সবগুলাকে ফাঁসি দিছি, এবার তোদেরও ছাড়ব না।’
তখন মাকসুদ কামালকে বলতে শোনা যায়- ‘হ্যাঁ, এবার এই ঝামেলাটা যাক, এরপরে আমিও নিজে ধরে ধরে যারা এই অস্থিরতা সৃষ্টি করছে, মেইন যারা আছে এদেরকে বহিষ্কার করব ইউনিভার্সিটি থেকে।’ শেখ হাসিনাও বলেন- ‘এইগুলাকে বাইর করে দিতে হবে... আমি বলে দিচ্ছি আজকে সহ্য করার পরে অ্যারেস্ট করবে, ধরে নেবে এবং যা অ্যাকশন নেয়ার নেবে... কারণ ইংল্যান্ডে এরকম ছাত্ররাজনীতির জন্য মাঠে নামল, কতগুলি মেরে ফেলায় দিলো না? ওই অ্যাকশন না নেয়া ছাড়া উপায় নাই। আমরা এত বেশি সহনশীলতা দেখাই... আজ এত দূর পর্যন্ত আসছে।’ এরপর তাদের মধ্যে আরও কথা হয়।
হেলিকপ্টার দিয়ে সোজা বোম্বিং করা হবে : শেখ হাসিনা ও হাসানুল হক ইনুর দুটি ফোনালাপ ট্রাইব্যুনালে শোনান বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা। দুটি ফোনালাপেই শেখ হাসিনার কোনো একটা পদক্ষেপে ইনুকে সমর্থন জানাতে শোনা যায়। সেই সঙ্গে কারফিউ যেন কঠোর হয়, শেখ হাসিনাকে সেই পরামর্শও দিতে শোনা যায় ইনুকে।
একটি ফোনালাপে ইনু-শেখ হাসিনাকে বলছেন- ‘শনির আখড়ায় কিছু মোল্লারাই...’ শেখ হাসিনা তখন বলছিলেন-‘খালি মোল্লা না ওইখানে অনেক মাদ্রাসা। ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে... মাইকিং করতে হচ্ছে আরকি... নারায়ণগঞ্জে ঢুকতে দিচ্ছে না আর্মিকে, আমরা ছত্রীসেনা নামাচ্ছি।’
ইনু জি, আচ্ছা বলে সাড়া দিলে শেখ হাসিনা বলে যান- ‘না আমি বলছি ক্যাজুয়াল্টির দরকার নাই। ওরা ব্যারিকেড দিয়ে আছে তো, ঠিক আছে। আকাশ থেকে নামবে, তখন দুই পাশ দিয়ে ধরবে। মেসেজটা দিয়ে দিতে পারেন যে, ছত্রীসেনা পাঠানো হচ্ছে। আর হেলিকপ্টার দিয়ে সোজা বোম্বিং করা হবে। র্যাবের হেলিকপ্টার দিয়ে ওপর দিয়ে মারবে।’
হাসানুল হক ইনু বলেন- ‘আচ্ছা ওপর দিয়ে সাউন্ড বোম যাবে আরকি, ঠিক আছে। আমি একটা পয়েন্ট আপনাকে একটু নজরে আনার জন্য রিকোয়েস্ট করতেছি যে, কারফিউ ধরেন দুই-পাঁচ দিন যা চললো, চললো। কিন্তু কারফিউ এর পরে যাতে আর মিছিল না নামতে পারে সেই জন্য একটা হোমওয়ার্ক করতে, করা দরকার। যে রকম- উত্তরা, বাড্ডা, গুলশান, যাত্রাবাড়ীতে যারা মিছিল লিড করছে সেইগুলা চিহ্নিত করা আরকি।’
হাসানুল হক ইনুকে বলতে শোনা যায়- ‘যাতে মিছিলটা লিড না করতে পারে। তা আমি ঢাকা শহরের জন্য বলছি যে, আপনার গোয়েন্দারা নিশ্চয়ই তালিকা করতে পারবে যে উত্তরায় কারা।’ তখন শেখ হাসিনা বলেন- ‘খালি গোয়েন্দারটা না, লোকাল লিডারদেরও করা উচিত।’
ফোনালাপের একপর্যায়ে হাসানুল হক ইনু বলেন- ‘আরেকটা রিকোয়েস্ট আমার, ইন্টারনেট আমার মনে হয় চালু করতে পারেন। এটা আমাদেরই কাজে লাগবে।’ তখন শেখ হাসিনা বলেন- ‘ভাই কী যে চালু করবো, সবতো পোড়াই দিছে। ডাটা সেন্টারও পোড়ায় দিছে, মেশিন সব পোড়ায় দিছে, এখন ওই নতুন তারতুর কিনে জোড়া লাগাতে হবে।’
একাত্তর টেলিভিশনে রাত ৮টায় টকশোতে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে জাসদ সভাপতি বলেন- ‘আমি বলবো যে (টকশোতে) সরকারের সাথে কোটা আন্দোলনকারীর কোনো বিরোধ নাই। সরকারের সাথে বিরোধ হচ্ছে নাশকতাকারী বিএনপি-জামাতের।’ এই কথা শেখ হাসিনা নিজেও বলেছেন বললে, ইনু বলেন- ‘এই জিনিসটা প্রপাগান্ডায় আনতে হবে যদি ইন্টারনেট থাকে, গণমাধ্যম দিয়ে আমরা পুরা নিউজে ফ্লাড করে দিলাম...।’
তখন শেখ হাসিনা বলেন- ‘ইন্টারনেট পাবো কোথায়? ইন্টারনেট পোড়ায় দিছে। জীবনে... আমি তো আর আনবো না। যদি অন্য সরকার আসে তাহলে আনবে। আমি দিছি ইন্টারনেট, ওরা পোড়াইতে থাকুক, ওইটা চলতে হবে...।’ হাসানুল হক ইনু তখন বলেন- ‘অন্য সরকার, বাংলাদেশে ইনশাআল্লাহ অন্য সরকার আসবে না।’ শেখ হাসিনা বলেন- ‘আসুক না, আমি আর পারবো না।’
দ্বিতীয় ফোনালাপেও কারফিউ কঠোর করতে শেখ হাসিনাকে পরামর্শ দিতে শোনা যায় ইনুকে। কথোপকথনের একপর্যায়ে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়- ‘বেশ কিছু আন্তর্জাতিক ইয়ে পাইছি। তারা এইটাকে জঙ্গি হামলা হিসেবে কনসিডার মানে বলতেছে।’ ইনু তখন বলেন- ‘হ্যাঁ, জঙ্গি হামলাই হইছে। এই কার্ডটা খেলবো আমরা এখন।’ শেখ হাসিনা বলেন- ‘না কার্ড খেলা না, এটা আমি আগে করি নাই। আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে আমাকে মেসেজটা দিছে যে এটা জঙ্গি হামলা।’ শেখ হাসিনা বলে চলেন- ‘তারা আমাকে এইটাই বলছে যে, এইটা জঙ্গি হামলা। দিয়ে দিব পেপারে।’ এই কথার পৃষ্ঠে ইনু বলেন- ‘আচ্ছা এইটা একটা ব্যাপার, আরেকটা হচ্ছে যে দুইটা ভাগ। একটা হচ্ছে- ছাত্রদের কোটা আন্দোলনকারী, আরেকটা হচ্ছে উৎখাতকারী। উৎখাতকারীরা জঙ্গি সন্ত্রাসী হামলায় চলে গিয়েছে। কোটা সংস্কারকারীর ব্যাপারে সরকারে যে যে আছি, সমবেদনা আছে। উৎখাতকারীকে আমি রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করবো। কোনো ছাত্র যদি উৎখাতকারীর সঙ্গে জড়িত হয়, সেই দায়িত্ব আমি নিবো না।’
ইনুর এই কথায় শেখ হাসিনাকে সায় দিতে শোনা যায় ফোনালাপে। এই ফোনালাপে সিপিবি, গণসংহতি আন্দোলনের নেতা জোনায়েদ সাকি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, আনু মুহাম্মদের নাম আসে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে আন্দোলনকারীদের অবস্থান, অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করতে চাওয়া, সংবিধান পরিবর্তন করার কথাও উঠে আসে তাদের ফোনালাপে।