বাতজ্বর শিশুদের অন্যতম একটি রোগ। আর তাই গিরা ফুলে গিয়ে জ্বর এলেই শিশুটি বাতজ্বরে আক্রান্ত হয়েছে ভেবে অভিভাবকেরা অনেক সময় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। আসলে এটি বাতজ্বর নয়, বাতরোগে আক্রান্ত হয়েছিল। বাতজ্বর নিয়ে অসচেতনতার কারণে এ রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে থাকে। রোগটি শনাক্তকরণ ও এর চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রেও জটিলতা রয়েছে।
১৬ বছর বয়সের নিচের যেকোনো শিশুর হাত-পা অথবা শরীরের অন্য কোনো গিরা ফোলা ও গিরাব্যথা ছয় সপ্তাহ ধরে থাকলে বাত রোগ বা জুভেনাইল ইডিওপেথিক আথ্রাইটিস বলা হয়। আগে এ রোগটির নামকরণ নিয়ে মতভেদ ছিল। মার্কিনিরা এ রোগটিকে জুভেনাইল রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস এবং ইউরোপীয়রা জুভেনাইল ক্রনিক আর্থ্রাইটিস হিসেবে নাম দিয়েছিল।
পরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯৯ সালে এ রোগটির বর্তমান নামকরণ করে ‘জুভেনাইল ইডিওপেথিক আথ্রাইটিস’। এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সুস্পষ্ট কারণ জানা যায়নি। তবে গবেষণায় কিছু বিষয়ের কথা, যেমন বংশগত প্রভাব ও পরিবেশগত প্রভাব। আবার সংক্রমণজনিতও, যেমন ভাইরাসজনিত কারণে এ রোগের সূত্রপাত ঘটে থাকে বলে জানা যায়। মূলত এটি একটি অটোইমিন ডিজঅর্ডার, যার ফলে দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থার ভুলের কারণে সুস্থ কোষ ও কলাগুলো প্রতিরোধ ব্যবস্থার আক্রমণের শিকার হয়ে উল্লিখিত রোগের সৃষ্টি করে। আমাদের দেশের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা যায়, প্রতি লক্ষ শিশুর মধ্যে ৬০ জন শিশু এই রোগে আক্রান্ত।
রোগের লক্ষণ :
দীর্ঘমেয়াদি গিরা ফোলা, ব্যথা ও গিরায় শক্ত ভাব, বিশেষ করে সকালবেলায় আধঘণ্টা থেকে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত থাকে। শিরায় ব্যথা থাকায় গিরাগুলোর নির্দিষ্ট কাজ, যেমন হাঁটা-বসা, লেখা ও অন্যান্য কাজকর্ম করতে সমস্যা হয়। প্রধানত হাঁটু, গোড়ালি, কবজি, কনুইয়ের বড় গিরা এবং হাত ও পায়ের পাতার ছোট গিরাগুলো আক্রান্ত হয়। এছাড়া তীব্র জ্বর, শরীরে লালচে দানা ছাড়াও যকৃৎ, প্লিহা, লসিকাগ্রন্থি বড় হয়ে যেতে দেখা যায়। চোখের সংক্রমণ কিছু ক্ষেত্রে দেখা দিতে পারে। রোগটির বিস্তৃতি এমন যে কখনো আক্রান্ত শিশুর কোনো অভিযোগ থাকবে না, অর্থাৎ শিশু ভালো থাকবে। আবার কখনো রোগের তীব্রতায় কাতর হবে। বাতরোগ ও বাতজ্বরের অনেক বিষয় একই রকমের মনে হলেও এ দুই রোগের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট। বাতরোগে আক্রান্ত শিশুদের সঠিক সময়ে চিকিৎসা প্রদান না করা হলে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক অক্ষমতা দেখা দিতে পারে। তাই সময়মতো রোগ নির্ণয় করে যথাযথ চিকিৎসা প্রদানের মধ্য দিয়ে আক্রান্ত শিশুর শারীরিক অবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে উদ্বিগ্ন মা-বাবার ভার লাঘব করা যেতে পারে।
বাতরোগ ও বাতজ্বরের মধ্যে পার্থক্য :
১. বাতরোগ ১৬ বছর বয়সের নিচে। বাতজ্বর পাঁচ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে।
২. বাতরোগের উৎপত্তি ধীরে ধীরে। বাতজ্বর হঠাৎ করে।
৩. বাত আক্রান্ত গিরার ধরন বড় ও ছোট গিরা প্রতিসমভাবে আক্রান্ত হয়। বাতজ্বর শুধু বড় গিরাগুলো অপরতিসমভাবে আক্রান্ত হয়।
৪. বাতরোগে গিরাগুলোর বিকৃতি থাকতে পারে। বাতজ্বরে থাকে না
৫. বাতরোগে আক্রান্ত গিরায় দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা দেখা দিতে পারে। বাতজ্বরে পুনরায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
৬. বাতরোগে মাংসপেশী শুকিয়ে যাওয়া ও দুর্বলতা থাকতে পারে। বাতজ্বরে থাকে না।
৭. বাতরোগে গিরা ছাড়া অন্য স্থানে সংক্রমণ (চোখ, যকৃৎ, প্লিহা, সেরোসাইটিস) হতে পারে। বাতজ্বরে হয় না।
৮. বাতরোগে অ্যাসপিরিন চিকিৎসার ফলাফল দ্রুত গিরা ফোলা ও ব্যথার উন্নতি দেখা যায় না। বাতজ্বরে নাটকীয়ভাবে গিরাব্যথা ও ফোলার উন্নতি দেখা যায়।
৯. বাতরোগের কারণ সুস্পষ্ট নয়। বাতজ্বরে গ্রুপ-এ বিটা হেমোলাইটিক স্ট্রেপটোকক্কাস-য কারণে শ্বাসনালির প্রদাহের সম্পর্ক রয়েছে। এমন কিছু উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসক এর পরামর্শ নিয়ে রাখা ভালো।
লেখক : শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ
শিশু রোগ বিভাগ, আলোক হাসপাতাল লিমিটেড, মিরপুর-১০। ফোন : ১০৬৭২
বিডি-প্রতিদিন/শআ