মঙ্গলবার, ২২ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
সাবধানতা জরুরি

নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব

অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব

খেজুর গাছের কাঁচা রস বাংলাদেশে অনেকের কাছেই বেশ জনপ্রিয় একটি পানীয়। এর থেকে গুড় বানিয়েও খাওয়া যায়। তবে কতজন এই বিষয়ে অবগত যে, কাঁচা খেজুরের রস পান অনেক ক্ষেত্রেই ভয়াবহ। কারণ এই রস পান করে ‘নিপাহ এন্সেফালাইটিস’ বা মস্তিষ্কেও প্রদাহ হয়ে মানুষ মৃত্যুর মুখেও পতিত হতে পারে। নিপাহ অপেক্ষাকৃত নতুন ভাইরাস, যা অতি সহজেই বাদুড় জাতীয় তৃণভোজী প্রাণী থেকে মানুষের দেহে প্রবেশ করে। শুধু বাদুড় নয়, নিপাহ শূকরের বর্জ্য থেকেও ছড়াতে পারে। ১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ার ‘সুঙ্গাই নিপাহ’ গ্রামে প্রথম এই ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেয়। সেখানে বাড়ির পোষ্য কুকুর, বিড়াল, ঘোড়া, ছাগলের দেহে এই ভাইরাসের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ওই অঞ্চলে প্রতিটি বাড়িতেই শূকর প্রতিপালন হয়। গবেষণার পর দেখা যায়, শূকর থেকেই নিপাহ ভাইরাস ছড়িয়েছে পোষ্যদের দেহে। ২০১৮ সালে ভারতের কেরালায় এই ভাইরাসের প্রকোপে ১১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। ভাইরাসটি আবিষ্কার করেন ড. কো বিং চুয়া। বাংলাদেশেও ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত মেহেরপুর, নওগাঁ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, ঠাকুরগাঁও, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জ ও রংপুরে মানবদেহে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের খবর পাওয়া গেছে। ২০০১ সালে উত্তর জনপদের সীমান্ত এলাকায় প্রথমবারের মতো নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা যাওয়ার পর এ পর্যন্ত এ ভাইরাসে আক্রান্ত ১৫২ জন। ২০০৪ সালে বাদুরের মাধ্যমে সংক্রমিত খেজুরের রস খেয়ে অনেকে এ রোগে আক্রান্ত হন। ২০১২ সালে আক্রান্ত হয়ে ১৮ জন এবং গত বছর ছয়জন মারা যান।

ভাইরাসের বাহক এবং কীভাবে ছড়ায় : নিপাহ ভাইরাস ছড়ায় মূলত পশুপাখি বিশেষ করে বাদুড়ের মাধ্যমে। বাংলাদেশে সাধারণত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এ সময়টাতেই খেঁজুরের রস সংগ্রহ করা হয়। আর বাদুড় গাছে বাঁধা হাঁড়ি থেকে রস খাওয়ার চেষ্টা করে বলে ওই রসের সঙ্গে তাদের লালা মিশে যায়। সেই বাদুড় নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকলে এবং সেই রস কোনো মানুষ খেলে, তাদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে পারে এ ভাইরাস। এ ছাড়া বাদুড়ে বা পশুপাখির খাওয়া ফলমূলের অংশ খেলে বা ভাইরাস বহনকারী শূকরের মাংস খেলে এ রোগ ছড়াতে পারে। এমনকি আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলেও মানুষ থেকে মানুষে রোগটি ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে।

রোগের লক্ষণ : নিপাহ ভাইরাস শরীরে প্রবেশের পাঁচ থেকে ১৪ দিন পর রোগের লক্ষণ প্রকাশিত হয়। লক্ষণ প্রকাশ ছাড়াও ৪৫ দিন পর্যন্ত ভাইরাসটি সুপ্ত অবস্থায় শরীরের মধ্যে থাকতে পারে। শুরুতে প্রচন্ড জ্বর, মাথা ও পেশিতে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, কাশি, পেট ব্যথা, বমি বমি ভাব, দুর্বলতা ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। এ ভাইরাসটি মানুষের মস্তিষ্ক আক্রান্ত করে এনসেফালাইটিস জাতীয় ভয়াবহ প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। ফলে রোগী প্রলাপ বকতে শুরু করে, ঘুমঘুম ভাব, মানসিক ভারসাম্যহীনতা, খিঁচুনি এবং অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। সময়মতো চিকিৎসা না হলে রোগী মৃত্যুর কোলেও ঢলে পড়ে।

এ রোগ প্রতিরোধের জন্য : খেজুরের কাঁচা রস পান করা উচিত নয়। গাছ থেকে খেজুরের রস সংগ্রহের হাঁড়ি ঢেকে রাখতে হবে। পাখি বা বাদুড়ে খাওয়া আংশিক ফল যেমন আম, লিচু, জাম, জামরুল, গোলাপজাম, কাঁঠাল, ডেউয়া, পেঁপে, পেয়ারা, বড়ই ইত্যাদি না খাওয়াই ভালো। ফলমূল পরিষ্কার পানি দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে খেতে হবে। আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে এবং রোগী পরিচর্যার পর সাবান ও পানি দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুতে হবে। 

লেখক : সাবেক ডিন, মেডিসিন অনুষদ, বঙ্গবন্ধু

শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর