বৃহস্পতিবার, ২০ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

বিশ্ব হাড় ক্ষয় দিবস আজ

অধ্যাপক ডা. সৈয়দ সহিদুল ইসলাম

বিশ্ব হাড় ক্ষয় দিবস আজ

বিশ্ব হাড় ক্ষয় দিবস আজ। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে এই দিনটি। প্রতি বছর ২০ অক্টোবর বিশ্বে হাড় ক্ষয় রোগ ও তার কারণে সৃষ্ট ভয়াবহ জটিলতা সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা তৈরির জন্য ‘বিশ্ব হাড় ক্ষয় দিবস’ পালন করা হয়।

এবারের বিশ্ব হাড় ক্ষয় দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়- ‘হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য পদক্ষেপ নিন’।

ষাটোর্ধ্ব সব পুরুষ ও নারীর পরীক্ষার মাধ্যমে হাড়ের ঘনত্ব পরিমাপ করে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী স্বাস্থ্যকর খাদ্য, প্রয়োজনীয় ব্যায়াম ও ওষুধ ব্যবহার করে হাড়কে মজবুত করতে হবে যাতে হাড় ভেঙে না যায়। হাড়ের যত্ন সুরক্ষিত করবে আপনার ভবিষ্যৎ জীবন।

অস্টিওপোরেসিস বা হাড় ক্ষয় কী?

হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়াকে হাড় ক্ষয় বলে। এতে হাড় ফাঁপা এবং ভঙ্গুর হয়ে পড়ে।

ফলে সামান্য আঘাতে বা বিনা আঘাতেই হাড় ভেঙে যায়। হাড় ক্ষয় রোগকে কাঠে ঘুণ ধরার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। পঞ্চাশোর্ধ্বে প্রতি তিনজন নারীর একজন এবং প্রতি পাঁচজন পুরুষের একজন হাড় ক্ষয় রোগে ভুগছেন এবং তাদের সবারই হাড় ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি আছে। অথচ তারা জানেই না, তাদের হাড় ক্ষয় রোগ আছে।

২০০৮ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, বিশ্বে ৫০০ মিলিয়ন পুরুষ ও মহিলা হাড় ক্ষয় রোগে আক্রান্ত। কিছু পরিসংখ্যান দিলে হাড় ক্ষয় রোগের ব্যাপকতা ও ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারণা করা যাবে। বিশ্বে হাড় ক্ষয়ের কারণে প্রতি বছর প্রায় ৯০ লাখ মানুষের হাড় ভেঙে যায়। অর্থাৎ প্রতি ৩ সেকেন্ডে একজনের হাড় ভেঙে যাচ্ছে। পঞ্চাশোর্ধ্ব নারী-পুরুষের হাড় ভাঙার ঝুঁকি ৪০% এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির সমান। নারীদের হাড় ক্ষয়জনিত কারণে হাড় ভেঙে যাওয়ার প্রবণতা সম্মিলিতভাবে হার্ট-অ্যাটাক, স্ট্রোক ও স্তন ক্যান্সারের চেয়েও বেশি (যোগফলের)। আশ্চর্যের বিষয়, শতকরা ৮০ জন মানুষই জানে না, তার হাড় ক্ষয় আছে এবং হাড় ভেঙে গেছে, (বিশেষ করে মেরুদন্ডের হাড়) এবং তারা কেউই হাড় ক্ষয়ের চিকিৎসা গ্রহণ করেনি। মেরুদন্ডের হাড় ভাঙা দুই তৃতীয়াংশ মানুষ জানেই না, তাদের হাড় ভেঙে গেছে।

নীরব ঘাতক হাড় ক্ষয় :

একজন হাড় ক্ষয়ে আক্রান্ত ব্যক্তির মেরুদন্ডের হাড় ভেঙে গেলে তার মৃত্যুঝুঁকি ৮ গুণ বেড়ে যায়। আর ঊরুসন্ধির হাড় ভেঙে গেলে তাকে সাধারণত অপারেশনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। যত আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা দেওয়া হোক না কেন ঊরুসন্ধির হাড় ভাঙার এক বছরের মধ্যে শতকরা ২৫ জন মৃত্যুবরণ করেন। যার সংখ্যা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণের কাছাকাছি এবং নারীদের ক্ষেত্রে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণের চেয়ে অনেক বেশি। এ কারণেই হাড় ক্ষয় রোগকে নীরব ঘাতক বলা হয়। হাড় ক্ষয়জনিত কারণে হাড় ভেঙে যাওয়ার পর মৃত্যুঝুঁকির পাশাপাশি যারা চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে ওঠেন তাদের অনেকেই আগের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে পারেন না। অনেককেই জীবনযাপনের জন্য অন্যের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। নিয়মিত চিকিৎসা ও নার্সিং সেবা গ্রহণ করতে হয়। ফলে শারীরিক অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। হাড় ক্ষয়জনিত কারণে হাড় ভেঙে গেলে ৮৬%, ক্ষেত্রে পরবর্তীতে দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার হাড় ভাঙার ঝুঁকি থাকে। এত ঝুঁকি ও জটিলতা থাকা সত্ত্বেও হাড় ক্ষয় রোগ নির্ণয়, প্রতিরোধ ও চিকিৎসার জন্য কোনো কার্যক্রম সরকারি বা বেসরকারিভাবে গ্রহণ করা হয় না। হাড় ক্ষয় যে একটি মারাত্মক রোগ এটা অনেকেই জানে না।

কেন হাড় ক্ষয় হয়?

দুই ধরনের হাড় ক্ষয় রোগ : ১. প্রাইমারি : বয়স বৃদ্ধির কারণে। আমাদের শরীরে প্রতিনিয়ত হাড় তৈরি ও ক্ষয় হয়। প্রথম প্রায় ২০ বছর পর্যন্ত হাড় ক্ষয়ের তুলনায় হাড় বেশি তৈরি হওয়ার জন্যই আমাদের হাড় লম্বা ও মোটা হয় এবং হাড়ের ঘনত্ব বাড়তে থাকে। ২০ থেকে ৪৫ বছর পর্যন্ত হাড় তৈরি ও ক্ষয় সমান সমান হয় বলে হাড় স্থিতি অবস্থায় থাকে। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে হাড় তৈরির চেয়ে ক্ষয় বেশি হওয়ায় হাড়ের ঘনত্ব কমতে থাকে। মেয়েদের শরীরে একটি বিশেষ হরমোন থাকে যার নাম ইস্ট্রোজেন। এটি নারীর সেকেন্ডারি যৌন বৈশিষ্ট্য বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং একই সঙ্গে মাসিকচক্রে কাজ করে। পাশাপাশি এই হরমোন হাড় ক্ষয়কারী কোষ অস্টিওক্লাস্টকে হাড় ক্ষয় করা থেকে নিবৃত্ত রাখে। ৪৫ বছর বয়সে এ হরমোন হঠাৎ করেই কমে যায় এবং নারীদের মাসিক বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় ইস্ট্রোজেনের অভাবে হাড় ক্ষয়কারী কোষের কাজ বেড়ে গেলে হঠাৎ করেই হাড় তৈরির চেয়ে হাড় ক্ষয় বেড়ে যায় এবং হাড়ের ঘনত্ব কমে যায়। এটাকেই পোস্ট মেনোপজাল (মাসিক বন্ধ পরবর্তী) হাড় ক্ষয় বা অস্টিওপোরেসিস বলে। পাশাপাশি পুরুষের স্বাভাবিক গতিতেই ধীরে ধীরে হাড় ক্ষয় হতে থাকে এবং ৬৫-৭০ বছর বয়সে তাদেরও হাড় ক্ষয় বেড়ে যায়।

সেকেন্ডারি অস্টিওপোরেসিস :

অনেক রোগ বা ত্রুটিপূর্ণ জীবনযাপন ও কিছু কিছু ওষুুধ ব্যবহারের কারণে যে হাড় ক্ষয় হয় সেটাই সেকেন্ডারি হাড় ক্ষয়।

কাদের ঝুঁকি বেশি :

অসংশোধনযোগ্য ঝুঁকি : ১. বয়স বৃদ্ধি-পঞ্চাশোর্ধ্বের নারী ও পুরুষ। ২. নারী

৩. উত্তরাধিকার ৪.৪৫ বছরের আগেই মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া ৫. অপারেশনের কারণে ডিম্বাশয় ফেলে দেওয়া ৬. অতি খর্বাকৃতি ৭. আগে হাড়ভাঙা ৮. যে কোনো কারণে দীর্ঘদিন শুয়ে বা বসে থাকা।

সংশোধনযোগ্য ঝুঁকি : ধূমপান, মদ্যপান কোমলপানীয় ও কফি পান, শরীরের ওজন কম হওয়া, স্বাস্থ্য খারাপ ও অনেকদিন শুয়ে/বসে থাকা। আমরা চেষ্টা করলেই এসব ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকতে পারি।

উপসর্গ কী?

হাড় ক্ষয় রোগের সাধারণত তেমন কোনো উপসর্গ থাকে না। কিছু কিছু কারণে আমরা অনুমান করতে পারি, হাড় ক্ষয় হতে পারে। যেমন- ১। উপরোক্ত উল্লেখিত ঝুঁকিসমূহ আছে কি না। ২। পূর্ব পুরুষ বা পরিবারে কারও হাড় ক্ষয় রোগ আছে কি না?

৩। যেসব রোগের কারণে সেকেন্ডারি

হাড় ক্ষয় রোগ হতে পারে সেসব রোগ আছে কি না।

৪। যেসব ওষুধ সেবন করলে হাড় ক্ষয় হয় সেসব ওষুধ সেবন করে কি না।

অনেক ক্ষেত্রে রোগী কোমর ব্যথা, মেরুদন্ড বাঁকা বা কুজো হয়ে যায়, উচ্চতা কমে যাওয়া এসব উপসর্গ থাকে। তবে বেশির ভাগ মানুষই হাড় ভেঙে যাওয়ার উপসর্গ নিয়ে আসে।

রোগ নির্ণয়ের জন্য কী করণীয় : উপসর্গ থাকুক বা না-ই থাকুক নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের DXA করে বি এমডির (BMD) পরিমাপ করতে হবে। বিএমডি পরিমাপ করে হাড় ভাঙার ঝুঁকি নির্ণয় করা অত্যন্ত জরুরি।

কাদের বিএমডি পরীক্ষা করতে হবে :

বাংলাদেশের জন্য- ১. ষাটোর্ধ্ব সব মহিলা ও পঁয়ষট্টি ঊর্ধ্ব সব পুরুষেরই হাড় ক্ষয় নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষা করতে হবে। ২. পঞ্চাশ বছর বয়সের পর যাদের হাড় ভেঙে গেছে। ৩. মাসিক বন্ধ হওয়া নারীদের কোনো রিস্ক ফ্যাক্টর থাকলে। ৪. পঞ্চাশোর্ধ্ব পুরুষের কোনো রিস্ক ফ্যাক্টর থাকলে।

হাড় ক্ষয় রোগ প্রতিরোধ : চিকিৎসা বিজ্ঞানে একটি কথা আছে-প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। প্রতিরোধ শুরু করতে হবে শিশুকাল থেকেই। শিশুকাল থেকে ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত আমাদের হাড়ের ঘনত্ব অনেক বেশি করে সঞ্চয় করে রাখতে হবে যাতে পরবর্তীতে হাড় মজবুত থাকে।

হাড় মজবুত রাখার জন্য করণীয় সমূহ :

১) খাবার : নিয়মিত সুষম খাবার খেতে হবে, যাতে প্রতি কেজি ওজনের জন্য প্রতিদিন ১.২ গ্রাম প্রোটিন থাকে। পরিমিত ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি খেতে হবে। আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় নিম্নোক্ত ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার রাখতে হবে যাতে প্রচুর ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়। যেমন-দুধ ও দুগ্ধজাতীয় খাবার, টকদই, পনির, কমলা, ডিম, কাঠবাদাম, তিল, খেজুর, সয়াবিন, ছোট মাছ, সামুদ্রিক মাছ, চিংড়ি মাছ। সবুজ শাকসবজিও ক্যালসিয়ামের খুব ভালো উৎস।

ভিটামিন-ডি সমৃদ্ধ খাবার :

ভিটামিন-ডি শুধু হাড়ের জন্য নয়, দেহের সুস্বাস্থ্যের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভিটামিন ডি পাওয়া যায় এমন সব খাবারের সংখ্যা খুবই কম। আর যেসব খাবারে ভিটামিন-ডি থাকে সেগুলো আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় খুবই অল্প থাকে। তৈলাক্ত মাছ, কলিজা, ডিমের কুসুম, মাখন, উন্নত প্রজাতির মাশরুম প্রভৃতি ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার। তবে সূর্যালোক থেকে ভিটামিন ডি পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়।

প্রয়োজনীয় ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডি না পাওয়া গেলে সাপ্লিমেন্ট নিতে হবে। ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার করতে হবে। কোমলপানীয় ও কফি যতদূর সম্ভব পরিহার করা। প্রতিদিন অন্তত এক ঘণ্টা সম্ভব হলে খালি গায়ে সূর্যালোকে থাকার চেষ্টা করা। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা বা ব্যায়াম করা। মাংসপেশির ব্যায়াম করলে যেমন হাড় ক্ষয় রোধ করে, তেমনি মাংসপেশি সবল ও মজবুত করে। ফলে পড়ে যাওয়ার প্রবণতা কমে যায়।বয়স্ক রোগীরা যাতে ঘরের মেঝেতে, সিঁড়িতে বা বাথরুমে পড়ে না যায় ব্যবস্থা করতে হবে। তাই হাড় ক্ষয় রোগ নিয়ে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে।

লেখক : সিনিয়র কনসালট্যান্ট, অর্থোপেডিক ও স্পাইন সার্জারি, এভারকেয়ার হাসপাতাল, ঢাকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর