প্রতি বছর ২০ অক্টোবর বিশ্বে হাড় ক্ষয় রোগ ও তার কারণে সৃষ্ট ভয়াবহ জটিলতা সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা তৈরি করার জন্য ‘বিশ্ব হাড় ক্ষয় দিবস’ পালন করা হয়। এবারের বিশ্ব হাড় ক্ষয় দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘ভঙ্গুর হাড়কে না বলুন’ অর্থাৎ হাড় ভঙ্গুর হওয়া প্রতিরোধ করুন এবং হাড় ক্ষয় হলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও চিকিৎসা গ্রহণ করুন।
আমাদের সুস্থ থাকা ও চলাফেরা করে দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড সম্পাদন করার জন্য হাড় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় অঙ্গ। ষাটোর্ধ্ব সব পুরুষ ও নারীর পরীক্ষার মাধ্যমে হাড়ের ঘনত্ব পরিমাপ করে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী স্বাস্থ্যকর খাদ্য, প্রয়োজনীয় ব্যায়াম ও ওষুধ ব্যাবহার করে হাড়কে মজবুত করতে হবে যাতে হাড় ভেঙে না যায়।
অস্টিওপোরেসিস বা হাড় ক্ষয় কী?
হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়াকে হাড় ক্ষয় বলে। এতে হাড় ফাঁপা এবং ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। ফলে সামান্য আঘাতে বা বিনা আঘাতেই হাড় ভেঙে যায়। হাড় ক্ষয় রোগকে কাঠে ঘুণ ধরার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। পঞ্চাশোর্ধ্বে প্রতি তিনজন নারীর একজন এবং প্রতি ৫ জন পুরুষের একজন হাড় ক্ষয় রোগে ভুগছেন এবং তাদের সবারই হাড় ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি আছে। অথচ তারা জানেই না যে তাদের হাড় ক্ষয় রোগ আছে। ২০০৮ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে বিশ্বে ৫০০ মিলিয়ন পুরুষ ও মহিলা হাড় ক্ষয় রোগে আক্রান্ত। কিছু পরিসংখ্যান দিলে হাড় ক্ষয় রোগের ব্যাপকতা ও ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারণা করা যাবে। বিশ্বে হাড়ক্ষয়ের কারণে প্রতি বছর ৫৫ বছরোর্ধ্ব ৩৭০ লক্ষ মানুষের হাড় ভেঙে যায়, অর্থাৎ প্রতি মিনিটে ৭০ জন মানুষের হাড় ভেঙে যাচ্ছে। পঞ্চাশোর্ধ নারী-পুরুষের হাড় ভাঙার ঝুঁকি ৪০% এবং এটা হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির সমান। নারীদের হাড় ক্ষয়জনিত কারণে হাড় ভেঙে যাওয়ার প্রবণতা সম্মিলিতভাবে হার্টঅ্যাটাক, স্ট্রোক ও স্তন ক্যান্সারের (যোগফলের) চেয়েও বেশি। আশ্চর্যের বিষয় যে শতকরা ৮০ জন মানুষই জানে না যে তার হাড় ক্ষয় আছে এবং হাড় ভেঙে গেছে, (বিশেষ করে মেরুদণ্ডের হাড়) এবং তারা কেউই হাড়ক্ষয়ের চিকিৎসা গ্রহণ করেনি। মেরুদণ্ডের হাড়ভাঙা দুই তৃতীয়াংশ মানুষ জানেই না যে তাদের হাড় ভেঙে গেছে। কারণ দৈনন্দিন স্বভাবিক কাজের মধ্যেই (যেমন সামনে ঝুঁকে কাজ করা, ভারী জিনিস তোলা বা বহন করা, হাঁচি-কাশি দেওয়া) তাদের হাড় ভেঙে যায়। এমনকি ৩০% ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে বিছানায় শোয়া অবস্থায়ই মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে যায়।
নীরব ঘাতক : হাড় ক্ষয় রোগের তেমন কোনো উপসর্গ থাকে না। হাড় ক্ষয়ের কারণে হাড় নরম ও ভঙ্গুর হয়ে ভেঙে গেলে মানুষ সাধারণত চিকিৎসকের কাছে যায়। একজন হাড়ক্ষয়ে আক্রান্ত ব্যক্তির মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে গেলে তার মৃত্যুঝুঁকি ৮ গুণ বেড়ে যায়। আর ঊরুসন্ধির হাড় ভেঙে গেলে তাকে অপারেশনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। যত আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা দেওয়া হোক না কেন ঊরুসন্ধির হাড় ভাঙার এক বছরের মধ্যে শতকরা ২৫ জন মৃত্যুবরণ করেন। যার সংখ্যা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণের কাছাকাছি। ভালো অপারেশনের পরেও এদের শতকরা ৪০ জন একাকী চলাফেরা করতে পারে না। অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। নারীদের ক্ষেত্রে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণের চেয়ে অনেক বেশি। এ কারণেই হাড় ক্ষয় রোগকে নীরব ঘাতক বলে।
কেন হাড় ক্ষয় হয়?
দুই ধরনের হাড় ক্ষয় রোগ- ১. প্রাইমারি : বয়স বৃদ্ধির কারণে শরীরে প্রতিনিয়ত হাড় তৈরি ও ক্ষয় হয়। প্রথম প্রায় ২০ বছর পর্যন্ত হাড় ক্ষয়ের তুলনায় হাড় বেশি তৈরি হওয়ার জন্যই আমাদের হাড় লম্বা ও মোটা হয় এবং হাড়ের ঘনত্ব বাড়তে থাকে। ২০ থেকে ৪৫ বছর পর্যন্ত হাড় তৈরি ও ক্ষয় সমান সমান হয় বলে হাড় স্থিতি অবস্থায় থাকে। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে হাড় তৈরির চেয়ে ক্ষয় বেশি হওয়ায় হাড়ের ঘনত্ব কমতে থাকে। মেয়েদের শরীরে একটি বিশেষ হরমোন থাকে যার নাম ইস্ট্রোজেন। এটি নারীর সেকেন্ডারি যৌন বৈশিষ্ট্য বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং একই সঙ্গে মাসিকচক্রে কাজ করে। পাশাপাশি এই হরমোন হাড় হাড় ক্ষয়কারী কোষ অস্টিওক্লাস্টকে হাড় ক্ষয় করা থেকে নিবৃত্ত রাখে। ৪৫ বছর বয়সে এ হরমোন হঠাৎ করেই কমে যায় এবং নারীদের মাসিক বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় ইস্ট্রোজেনের অভাবে হাড় ক্ষয়কারী কোষের কাজ বেড়ে গেলে হঠাৎ করেই হাড় তৈরির চেয়ে হাড় ক্ষয় বেড়ে যায় এবং হাড়ের ঘনত্ব কমে যায়। এটাকেই পোস্ট মেনোপজাল হাড় ক্ষয় বা অস্টিওপোরেসিস বলে। পাশাপাশি পুরুষের স্বাভাবিক গতিতেই ধীরে ধীরে হাড় ক্ষয় হতে থাকে এবং ৬৫-৭০ বয়সে তাদেরও হাড় ক্ষয় বেড়ে যায়।
২. সেকেন্ডারি অস্টিওপোরেসিস : অনেক রোগ বা ত্রুটিপূর্ণ জীবনযাপন ও কিছু ওষুুধ ব্যবহারের কারণে যে হাড় ক্ষয় হয় সেটাই সেকেন্ডারি হাড় ক্ষয়।
সেকেন্ডারি হাড় ক্ষয় রোগসমুহ: হাইপার থাইরয়েডিজম হাইপার প্যারাথাইরেডিজম, হাইপোগোনাডিজম ডায়াবেটিস, কুসিং সিনড্রোম, পরিপাকতন্ত্রের অসুখ, বাতজাতীয় রোগ, কিডনির রোগ। বেশ কিছু ওষুধ দীর্ঘদিন সেবন করলেও হাড় ক্ষয় হয় যেমন- স্টেরয়েড, হেপারিন, পেপটিক আলসারের ওষুধ, এন্টিকনভালস্যান্ট ইত্যাদি।
-অধ্যাপক ডা. সৈয়দ সহিদুল ইসলাম, সিনিয়র কনসালট্যান্ট, অর্থোপেডিক ও স্পাইন সার্জারি, ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল ও সুপার স্পেশালিটি সেন্টার, ঢাকা।