'কীভাবে আমার সঙ্গীর কথা বাবা-মাকে বলবো, তাদের সাথে পরিচয় করিবে দেব?'- কৃষ্ণাঙ্গদের প্রেমে পড়ে যেসব দক্ষিণ এশীয় বা ভারতীয় বংশোদ্ভূত তার কাছে সাহায্যের জন্য যোগাযোগ করেন তাদের কাছ থেকে হর-হামেশা এই প্রশ্ন শুনতে হয় জোনাহ বাতামবুযেকে।
উগান্ডান বংশোদ্ভূত এই কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান এবং তার ভারতীয় বংশোদ্ভূত স্ত্রী শোয়েতা গত তিনবছর ধরে কৃষ্ণাঙ্গ এবং ভারতীয়দের মধ্যে প্রেম এবং প্রণয়ে সাংস্কৃতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক বাধা দূর করতে অনলাইনে একটি নেটওয়ার্ক চালান।
তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ জোনাহ‘র জন্ম এবং বড় হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে। তার বাবা-মা স্বৈরশাসক ইদি আমিনের শাসনামলে উগান্ডা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
অন্যদিকে চোখের ডাক্তার শোয়েতার জন্ম ভারতের অন্ধ্র প্রদেশে। খুব ছোটবেলায় বাবা-মার সাথে ব্রিটেনের চলে আসেন।
দুজনের দেখা এবং পরিচয় ২০০১ সালে আয়ারল্যান্ডে। তারপর প্রেম এবং বিয়ে। দুটো সন্তান তাদের।
জোনাস-শোয়েতা দম্পতি এবং আরো একটি কৃষ্ণাঙ্গ এবং দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত দম্পতির সাথে কথা বলেছেন বিবিসির নলিনি শিবাস্তাসান।
হ্যাশট্যাগ ব্লিনডিয়ান
পরিবারের স্বীকৃতি পেতে জোনাহ-শোয়েতা দম্পতিকে প্রচুর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।
সে কারণে তাদের মত দম্পতিদের সাহায্য করতে এবং সেইসাথে এ ধরণের সম্পর্ক নিয়ে সমাজের কুসংস্কার-ভীতি দূর করতে ২০১৭ সালে তারা অনলাইনে ‘হ্যাশট্যাগ ব্লিনডিয়ান প্রজেক্ট‘ নামে একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেন। তাদের মত এমন অনেক নতুন দম্পতি, প্রেমিক-প্রেমিকাকে পরামর্শ দেন তারা।
তবে এ ধরণের প্রেমে বাধা বেশি পোহাতে হয় প্রধানত দক্ষিণ এশীয়দের।
জোনাহ বলছিলেন এশীয়দের প্রধান সংকট ''কীভাবে তারা তাদের কৃষ্ণাঙ্গ সঙ্গীদের কথা পরিবারের কাছে পাড়বে?''
কীভাবে, কোন পন্থায় সঙ্গীর কথা পরিবারকে জানানো যেতে পারে তা নিয়ে জোনাহ এবং শোয়েতা দম্পতি বেশ কিছুদিন ধরে অনলাইনে ওয়ার্কশপ করছেন।
“অধিকাংশ মানুষের মধ্যে একটা ভয় কাজ করে। কারণে তারা সবাই পারিবারিক, সাংস্কৃতিক কিছু মূল্যবোধ ধারণ করে বড় হয়। এশীয়দের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ সমাজ নিয়ে এখনো এক ধরণের অজানা সন্দেহ কাজ করে, “ বলছিলেন শোয়েতা।
সানিয়া-মাইকেল দম্পতি এবং কমালা হ্যারিস
এশীয় বংশোদ্ভূত সানিয়া সেলিম বিবিসির কাছে বলেছেন তার কীভাবে তিনি তার কৃষ্ণাঙ্গ প্রেমিক মাইকেল অ্যারনের কথা পরিবারকে জানিয়েছিলেন।“প্রথমে যে সমস্যায় আমি পড়েছিলাম তা হলো পরিবারের মধ্যে এমন একজনকে বের করা যে আমার পক্ষ নেবে,“ বলছিলেন সানিয়া।
তিনি পেয়েছিলেন তার বড় ভাইকে। সানিয়া প্রথম তার বড় ভাইয়ের সাথে মাইকেলের পরিচয় করিয়ে দেন।
“জানার পর আমার বাবা প্রায় মাস খানেক আমার সাথে কোনো কথাই বলেননি। আমার ভাই পরিবারের মধ্যে এ নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। এমন বড় বিতর্ক আর সঙ্কট আমাদের পরিবারে আগে আর কখনো হয়নি।“
তবে সানিয়া এবং মাইকেল মনে করেন, সম্প্রতি ‘ব্লাক লাইভ ম্যাটারস‘ আন্দোলন এবং যুক্তরাষ্ট্রে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে কমালা হ্যারিসের বিজয় এশীয় সমাজে কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে মনোভাবে কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সাহায্য করেছে।
সানিয়া বলেন, “কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে পুলিশের নির্যাতন নিয়ে আমরা যা দেখেছি তা নিয়ে আমি বাবা-মার সাথে অনেক কথা বলি। তারপর যখন কমালা হ্যারিস জিতলেন আমি মাকে বলি দেখ কমালা হ্যারিস কিন্তু ব্লিনডিয়ান। আমার এবং মাইকেলের বাচ্চারা কিন্তু তারই মত হবে।“
মাইকেলও মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের দুটো ঘটনা তার এবং সানিয়ার সম্পর্ক নিয়ে পরিবারের মধ্যে বরফ গলাতে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে।
দিন বদলাচ্ছে
ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামে ব্লিনডিয়ান প্রকল্পের পাতায় এখন প্রতিদিনই নতুন নতুন এশীয় এবং কৃষ্ণাঙ্গ দম্পতিরা খোলাখুলিভাবে তাদের কথা বলছেন, সম্পর্ক নিয়ে পরিবারের সাথে তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন। ছবি পোস্ট করছেন।
জোনাহ এবং শোয়েতা মনে করেন তাদের এই প্রয়াসে এ ধরণের সম্পর্ক নিয়ে সাংস্কৃতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক বাধা দূর করতে সাহায্য করছে। প্রায় হাজারখানেক কৃষ্ণাঙ্গ-দক্ষিণ এশীয় দম্পতি এখন এই নেটওয়ার্কে যুক্ত হয়েছেন।
জোনাহ বলেন, ঐতিহাসিকভাবে দক্ষিণ এশীয় এবং কৃষ্ণাঙ্গরা বিশ্বের অনেক জায়গায় পাশাপাশি বসবাস করছে। “উগান্ডার কথাই ধরুন, পশ্চিম আফ্রিকা। ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ - এসব জায়গায় বহুদিন ধরে এই দুই সম্প্রদায় পাশাপাশি আছে । তাদের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে।“
স্বামীর কথায় সায় দিলেন শোয়েতা। 'ঠিক কথা। আমাদের খাবার, আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে অনেক মিল রয়েছে, এবং অমিলের চেয়ে এই মিলের স্বীকৃতি আমাদের সন্তানদের জন্য খুবই জরুরী। আমার দুই সন্তানের বয়স ছয় এবং চার। তারা মিশ্র বর্ণের হয়ে বড় হচ্ছে। এবং আমরা চাই চামড়ার রং নিয়ে যেন তাদের মধ্যে কখনো কোনো মানসিক সংকট তৈরি না হয়। তরা যেন এ নিয়েই সুখী হয়।' সূত্র: বিবিসি বাংলা
বিডি প্রতিদিন/আরাফাত