লিবিয়ায় চলছে নানা উপদলের মধ্যে যুদ্ধ, গোত্রে গোত্রে সহিংসতা। আবদেল মানাম মাহমুদ পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে কবরে নেমে ভাই এসমাইলের দেহ অন্তিম শয্যায় রাখার দায়িত্বটা তার কাঁধেই বর্তায়। তবে কবরটি হয়তো তার ভাইয়ের নাও হতে পারে।
কাছেই কবর দেওয়া হয়েছে লিবিয়ার গৃহযুদ্ধের শিকার মাহমুদের বাবা হুসেইন, তার ভাই নূরী এবং চাচা মোহাম্মদকে। তবে মাহমুদ পরিবারের সবাই নিহত হয়েছে একই মিলিশিয়া বাহিনীর হাতে।
গত বছর লিবিয়ায় যুদ্ধবিরতির চুক্তি হয়েছিল বলেই এই দেহগুলো খুঁজে পাওয়া গেল। ২০১১ সালে মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের পর থেকে দেশটি বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা এবং গৃহযুদ্ধের মধ্যে আছে। তবে সেই যুদ্ধ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চরমে পৌঁছে যখন ৭৭ বছর বয়সী জেনারেল খালিফা হাফতার উত্তরের নগরী বেনগাজী থেকে আক্রমণ চালিয়ে ত্রিপোলির আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা চালান।
তার পেছনে ছিল অনেক শক্তিশালী দেশের মদত- সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, সিরিয়া, জর্ডান এবং এমনকি ফ্রান্স। ত্রিপোলির ওপর তিনি বিদ্যুৎ-বেগে যে আক্রমণ চালান সেটি অবশ্য বেশ দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে রূপ নেয়। এই যুদ্ধে তুরস্ক ত্রিপোলির সরকারের সমর্থনে সেখানে নৌবাহিনী এবং ড্রোন পাঠায়। এর ফলে জেনারেল খালিফা হাফতারের বাহিনী পর্যদুস্ত হয়।
তবে লিবিয়ার এই বিষাক্ত ক্ষমতার লড়াইয়ে আরও যুক্ত হয়েছে সিরিয়ার ভাড়াটে সৈন্যরা। তারা বেশিরভাগই লড়ছে সরকারের পক্ষে, তুরস্কের নেতৃত্বে। জেনারেল হাফতারের পক্ষেও এ রকম ভাড়া করা সৈন্য আছে - রুশ ঠিকাদার এবং সুদান ও শাদ থেকে আসা যোদ্ধারা।
এসব রক্তাক্ত লড়াইয়ে নিহতের সংখ্যা কেবলই বাড়ছে। লিবিয়া এর আগেও বহুবার ধ্বংসের প্রান্তসীমায় পৌঁছেছিল। কিন্তু সেখান থেকে দেশটি এরপর যেন আরও বড় বিপর্যয়ের দিকে গেছে।
তবে লিবিয়ায় শেষ পর্যন্ত একটা যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে সমঝোতা হয়েছে এবং বহু বছরের মধ্যে এই প্রথম দেশটিতে একটি ঐক্যের সরকার গঠিত হয়েছে। এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন আবদুল হামিদ ডিবেইবাহ। তিনি লিবিয়ার বাণিজ্যিক শহর মিসরাতার লোক, সেখানকার এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। লিবিয়ার সাবেক শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফির সঙ্গে তাদের পরিবারের সম্পর্ক ছিল। তবে আবদুল হামিদ ডিবেইবাহ সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়, বলা যেতে পারে রাজনীতিতে তিনি নতুন।
ডিবেইবাহ কিভাবে জাতিসংঘের উদ্যোগে শুরু হওয়া এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গঠিত একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হলেন, তা ব্যাখ্যা করছিলেন ত্রিপোলিতে একজন পশ্চিমা কূটনীতিক। ‘ডিবেইবাহ আসলে কারও অপছন্দের তালিকায় নেই’, বলছেন তিনি।
লিবিয়ায় আগামী নয় মাসের মধ্যে নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু লিবিয়ার স্বাধীনতা দিবস ২৪ ডিসেম্বরে এই নির্বাচন করা যাবে কি না, তা নিয়ে এরই মধ্যে সংশয় দেখা দিয়েছে। ‘এই সময়সীমাটা খুব আঁটোসাঁটো, তবে একদম অসম্ভব নয়। তবে অবশ্যই এটা লিবিয়ার সব প্রতিষ্ঠান এবং কর্তৃপক্ষের ওপর নির্ভর করে’, বলছেন লিবিয়ায় জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়ান কুবিস। তিনি বলেন, হয় তাদের এই আয়োজন করতে হবে, যাতে নির্বাচন করা যায়। নয়তো .. তারা এটা না করার জন্য অজুহাত বা যুক্তি খুঁজে বের করবে .. আমি আশা করবে এমনটি ঘটবে না। কারণ দেশের জনগণ নির্বাচন চায়।
তিনি আরও বলেন, এটা তো শুধু কর্তৃপক্ষের ঘোষণা বা প্রতিশ্রুতি নয়। এটা লিবিয়ার জনগণের আকাঙ্ক্ষা, তারা চায় ২৪ ডিসেম্বর দেশে নির্বাচন হবে।
টারহুনা শহরের বহু মানুষের বিশ্বাস, সাতজন কানি ভাই যে এত ক্ষমতাবান হয়ে উঠলো, তার পেছনে খালিফা হাফতারের সমর্থন আছে। (মাহমুদের অভিযোগ, এরাই তার আত্মীয়দের হত্যা করেছে)। শহর ছেড়ে যাওয়ার আগে তারা হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল। অনেকের সন্দেহ, এই জেনারেল বেঁচে থাকা বাকি কানি ভাইদের আশ্রয় দিচ্ছেন। এদের অনেকের নাম আছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় নিষেধাজ্ঞার তালিকায়।
পশ্চিম দিক থেকে ত্রিপোলির ওপর আক্রমণ চালানোর জন্য টারহুনা শহরকে ব্যবহার করা হয়। লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ যেভাবে ক্রমে এক আন্তর্জাতিক বিরোধে পরিণত হয়েছে, সেখানে এই টারহুনা অন্যতম এক সংঘাতে কেন্দ্র।
এই শহর থেকেই জেনারেল হাফতারের বাহিনী - যার নাম 'লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি' - রাজধানী ত্রিপোলির ওপর হামলা চালায়। রাশিয়ার ভাড়াটে বাহিনী "ওয়াগনার গ্রুপ", তারাও অবস্থান নিয়েছিল এই শহরে।
শহরটির কবরস্থানে আজ ১৩টি দেহ কবর দেয়া হয়েছে। শহরের পুরুষ এবং বালকদের সবাই এখানে এসেছে - শুক্রবারের জুমার নামাজ শেষে শয়ে শয়ে। অনেকে তাদের জায়নামাজ দিয়ে বিকেলের খররোদ থেকে নিজেদের আড়াল করছিল। আনুষ্ঠানিকতা শেষ মাহমুদ বললেন, তারা আমার পরিবারকে বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়েছিল। তারা ছিলেন সাধারণ বেসামরিক মানুষ। কিন্তু ২০২০ সালের অক্টোবরে আল-কানি মিলিশিয়ারা সরকারি গাড়িতে চেপে আমাদের বাড়িতে এলো। আমার পরিবারের সদস্যদের তারা ধরে নিয়ে গেল, তারপর হত্যা করলো।
তিনি ১০ মাস ধরে তার পরিবারকে খুঁজেছেন, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। প্রথমে হুসেইন, নূরী এবং মোহাম্মদের দেহ খুঁজে পাওয়া যায়। দুই মাস আগে পাওয়া যায় এসমাইলের দেহ। মাহমুদ বলেন, গাদ্দাফির শাসনের অবসানের পর যে ধরনের হত্যাকাণ্ড আমরা দেখেছি, এমনকি তার ৪২ বছরের শাসনেও আমরা তেমনটি দেখিনি। আমরা যারা লিবিয়ার বেসামরিক মানুষ, আমাদের রক্ষা করার জন্য কেউ নেই। আমাদের জীবন এখন সম্পূর্ণ অরক্ষিত।
কানি ভাইদের সাতজন খ্যাতি অর্জন করে ত্রিপোলির চিড়িয়াখানা থেকে তিনটি সিংহ চুরি করে এনে তাদের বাড়িতে পোষা প্রাণী হিসেবে রেখে। তাদের দাপট প্রচণ্ড। লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে এই মিলিশিয়া বাহিনী বার বার পক্ষ বদল করেছে। তবে গত বছরের জুন মাসে তাদের শাসনের অবসান ঘটে, যখন তুর্কীদের সমর্থনে সরকারি বাহিনী শহরটি দখল করে নেয়। তুরস্ক সাতটি ফ্রিগেট পাঠিয়েছিল লিবিয়ার উপকূলে, যাতে জেনারেল হাফতারের বাহিনীকে পিছু হটানো যায়। তারা এর পাশাপাশি ইদলিব, আলেপ্পো এবং ডের এযুর থেকে অনেক যোদ্ধাকে লিবিয়ায় নিয়ে আসে লড়াই করার জন্য।
এই তীব্র হামলার মুখে বাদবাকি কানি ভাইরা এবং তাদের পরিবার লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে পালিয়ে যায়। তারা এখন কোথায় আছে কেউ জানে না।
মুসলিম রীতি অনুযায়ী টারহুনার কবরস্থান একেবারেই আড়ম্বরহীন। কবরস্থানের চারিদিকে কিছু তৃষ্ণার্ত ইউক্যালিপটাস গাছ, এখানে সেখানে কবরের ওপর কয়েকটি নামফলক। তবে এসমাইলের কবরের নাম ফলকে একটি সংখ্যা লেখা আছে: ০৫১-০০০০৬৬। এটি আসলে ডিএনএ রেফারেন্স। কারণ আজকে যে দেহটি এখানে কবর দেয়া হয়েছে, সেটি এসমাইলের নাও হতে পারে। কেবল পরনের কাপড় দেখে এসমাইলকে চিহ্নিত করা হয়। দক্ষিণের এক শহরের গণকবরে তার দেহটি পাওয়া গিয়েছিল।
খামার বাড়ির দিকে যে রাস্তাটি গেছে, সেটি আলমন্ড ঝোপে ঘেরা। ঢোকার মুখে কার্ড-বোর্ডে লেখা সতর্কবাণী: ‘প্রবেশ নিষেধ, কেবল নিখোঁজ ব্যক্তিদের কমিটিই ঢুকতে পারবে।’
বাড়িটির পর লাল মাটির সারি সারি কবর চলে গেছে একেবারে শেষ সীমানা পর্যন্ত। গুনে শেষ করা যাবে না, এতো। কোন কোনটি একটি দেহের আকৃতির কবর, কোন কোনটি অনেক চওড়া। পুরো এলাকাটি শান্ত। কিন্তু এখানে অপরাধ উদঘাটনের যে চেষ্টা চলছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, তার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। একটি খাদে চারটি লাল পতাকা দিয়ে চারজনের দেহ চিহ্নিত করা। দেহগুলো একসঙ্গে মোড়ানো, চেনা প্রায় অসম্ভব।
এখানে পুরুষ, নারী, শিশু - সবাইকে কবর দেয়া হয়েছে। কাউকে মাথায় একটি মাত্র গুলি করে হত্যা করা হয়। অনেকের ছিল হাত বাঁধা, দেহে নির্যাতনের চিহ্ন। শুকনো মাটিতে দেহগুলো সেভাবেই ছিল, তবে ফুলে উঠেছিল। যেন কোন এক ভয়ংকর দুর্যোগের নিদর্শন।
ত্রিপোলির এক ল্যাবে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমেই কেবল এসমাইলের পরিচয় নিশ্চিত করা যাবে। এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে ১৪০টি দেহ। লিবিয়ার নিখোঁজ মানুষদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব যে সংস্থার, তাদের দেয়া পরিসংখ্যান এটি। ডিএনএ মিলিয়ে এ পর্যন্ত তারা ২২টি মরদেহের পরিচয় বের করেছে।
সব মিলিয়ে এই শহর থেকে নিখোঁজ হয়েছিল সাড়ে ৩০০ মানুষ। যদিও অন্যান্য জায়গার কিছু মানুষকেও হয়তো এখানে কবর দেয়া হয়েছে। মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের পর লিবিয়া জুড়ে প্রায় ছয় হাজার মানুষ নিখোঁজ হয়েছে। তাদের মধ্যে মাত্র ১ হাজার ৯৫০ জনকে খুঁজে পাওয়া গেছে।
কবরস্থানে এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিলেন আহমদ আবদেল-মোরি সাদ, যিনি তার এক বন্ধুকে কবর দিতে এসেছেন। টারহুনা এক ভূতের নগরী, বলছেন তিনি। তিনি আরো বলেন, আমার সাত ভাই ছিল, যাদেরকে কানিয়াত মিলিশিয়ারা অপহরণ করে। তাদের মধ্যে দু'জনকে গণকবরে পাওয়া গেছে, তাদেরকে আমরা এখানে কবর দিয়েছি।
সাদ জানেন না তার বাকি ভাইরা কোথায়। তবে তার বিশ্বাস, তারা মারা গেছে। তাদের সবার ছেলে-মেয়েদের দেখার দায়িত্ব এখন তার কাঁধে - সব মিলিয়ে ২৪ জন। তিনি বলেন, আমরা কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নেই; আমরা পুলিশও নই, সেনাও নই। যদি আপনার অর্থ থাকে, আপনি মারা পড়বেন। যদি আপনার পাঁচটা ভাই থাকে, আপনি মরবেন। আপনি আমার সঙ্গে কিছু নিয়ে আলাপ করবেন, আপনি মারা যাবেন। আপনি আমাকে সমর্থন না করলেও আপনি মরবেন। বিনা কারণেই আপনি মরবেন, এটি কোনো কারণ ছাড়া এক মৃত্যু।
বিডি প্রতিদিন/ অন্তরা কবির