নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কানাডা, মেক্সিকো এবং চীন থেকে পণ্য আমদানির ওপর শুল্ক আরোপ করেছেন ট্রাম্প প্রশাসন। এতে পুরো বিশ্বজুড়েই দেখা দিয়েছে তীব্র প্রতিক্রিয়া। তবে নিজের সিদ্ধান্তে অনড় ট্রাম্প।
ট্রাম্পের নেয়া সিদ্ধান্তে মেক্সিকান এবং কানাডিয়ান পণ্য আমদানির উপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে এবং চীনা পণ্য আমদানির ওপর আরোপ করা হবে ১০ শতাংশ শুল্ক।
মার্কিন গণমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল তাদের সম্পাদকীয়তে ট্রাম্পের এই শুল্ক আরোপকে ‘ইতিহাসের সবচেয়ে বোকা বাণিজ্য যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেছে।
এই সিদ্ধান্তের প্রভাব যে মার্কিন অর্থনীতিতে পড়বে, সে সম্পর্কেও অবগত রয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে পাশাপাশি নানা সমালোচনার জবাবও দিয়েছেন তিনি। নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে একটি পোস্টে তিনি বলেছেন, চীন, মেক্সিকো এবং কানাডার মতো অন্যান্য দেশগুলো দশক ধরে ‘আমেরিকাকে লুটপাট’ করছে।
তিনি লিখেছেন, ‘এটা হবে আমেরিকার স্বর্ণযুগ। কিছু কষ্ট কি থাকবে? হ্যাঁ, হয়তো (হয়তো নাও হতে পারে!)। কিন্তু আমরা আমেরিকাকে আবার মহান করে তুলবো, এবং এর মূল্য পরিশোধ করতে হবে।’
ট্রাম্প লিখেছেন, ‘কানাডা আমাদের প্রিয় ৫১তম রাষ্ট্র হওয়া উচিত।’
তিন দেশের ওপর শুল্ক আরোপে পক্ষে যুক্তি দিয়ে ট্রাম্প বলেছেন, ‘আপনারা পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি করুন, এখানে কোনো শুল্ক নেই’।
ট্রাম্প ঘোষিত নতুন শুল্কের ‘তীব্র বিরোধিতা’ করে ‘নিজস্ব অধিকার এবং স্বার্থ দৃঢ়ভাবে রক্ষা করার জন্য সংশ্লিষ্ট পাল্টা ব্যবস্থা’ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে চীন। চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ওয়াশিংটনের ‘ভ্রান্ত আচরণের’ সমালোচনা করে বলেছে যে বেইজিং ‘এতে ব্যাপক অসন্তুষ্ট।’
এই ইস্যুতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ডাব্লিউটিওতে মামলা কথাও জানিয়েছে বেইজিং।
চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যুক্তি, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা শুল্ক আরোপ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়মের গুরুতর লঙ্ঘন।’ চীনের দাবি, এই শুল্ক‘কেবলমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ নয়, বরং স্বাভাবিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সহযোগিতাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।’
ডাব্লিউটিওতে আপিলকে মূলত প্রতীকী হিসেবে দেখা হয়। ২০১৯ সালে চীনের সঙ্গে আরেকটি শুল্ক যুদ্ধের সময় ট্রাম্প আপিল পরিচালনার জন্য বিচারক নিয়োগ বাধাগ্রস্ত করেন। এরপর থেকে ডাব্লিউটিও এর বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা কার্যকরভাবে বন্ধই রয়েছে।
তবে এর ফলে যে নিয়ম-ভিত্তিক বাণিজ্য ব্যবস্থাকে যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন সমর্থন করে এসেছে, সেই ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে চীন বিশ্ববাজারে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে পারে।
উদ্বেগের ছায়া পড়েছে জার্মানি ও ইউরোপেও
বিভিন্ন দলের জার্মান রাজনীতিবিদরা ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
রক্ষণশীল বিরোধী খ্রিস্টান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নের (সিডিইউ) চ্যান্সেলর পদপ্রার্থী এবং ফেব্রুয়ারিতে জার্মানির আগাম নির্বাচনে আপাতদৃষ্টিতে এগিয়ে থাকা ফ্রিডরিশ ম্যার্ৎস উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বাণিজ্য নীতির দ্বন্দ্ব সমাধানে শুল্ক আরোপ কখনওই ভালো ধারণা নয়।’
বাড়তি শুল্কের ফলে আমেরিকান ভোক্তাদের ওপরেই বোঝা বাড়বে এবং এর ফলে দেশটিতে প্রতিরোধের সূত্রপাত হবে বলে মনে করেন তিনি। ইউরোপীয় ইউনিয়নকে এখন থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিতে হবে বলেও মনে করেন ম্যার্ৎস।
জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎসও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি ‘পণ্য ও পণ্যের বিশ্বব্যাপী বিনিময়’ নীতির প্রশংসা করে বলেছেন যে ‘ব্যাপক শুল্ক বাধা দিয়ে বিশ্বকে বিভক্ত না করাটা গুরুত্বপূর্ণ’।
ইউরোপের ক্ষেত্রে এর সম্ভাব্য প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে শলৎস বলেন, ইইউ একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং এটির ‘কার্যক্রম পরিচালনায় নিজস্ব বিকল্প’ রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘ইউরোপ ভয়ে লুকাবে না, বরং একটি গঠনমূলক এবং দৃঢ় অংশীদার হবে।’
নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প ইইউকে ‘ক্ষুদ্র-চীন’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। অক্টোবরের শেষের দিকে তিনি জোটটিকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন এবং ‘ট্রাম্প পারস্পরিক বাণিজ্য আইন’ পাস করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, ‘তারা (ইইউ) আমাদের গাড়ি নেয় না। তারা আমাদের কৃষি পণ্য নেয় না। তারা যুক্তরাষ্ট্রে লক্ষ লক্ষ গাড়ি বিক্রি করে।’ পেনসিলভানিয়ায় এক সমাবেশে তিনি আরও বলেছিলেন। ‘না, না, না। তাদের একটি বড় মূল্য দিতে হবে।’
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ট্রাম্পের প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক নীতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য এবং বিশেষ করে জার্মানির জন্য বড় সমস্যা তৈরি করবে।
ইফো ইনস্টিটিউটের গবেষণা বলছে, আমদানিকৃত পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে জার্মান রপ্তানি প্রায় ১৫ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে এবং ৩৩ বিলিয়ন ইউরোর (৩৫.৩ বিলিয়ন ডলার) অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে।
কোলন-ভিত্তিক জার্মান অর্থনৈতিক ইনস্টিটিউটটি আরও আশঙ্কা করছে, দুই পক্ষেই ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হলে যে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হবে, তাতে ট্রাম্পের চার বছরের মেয়াদে জার্মান অর্থনীতিতে ১২৭ বিলিয়ন ইউরোর ক্ষতি হতে পারে। ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপের হলে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ১৮০ বিলিয়ন ইউরোতে।
যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ এর মধ্যে শুল্ক দ্বন্দ্ব মার্কিন অর্থনীতির জন্যও সমস্যা হয়ে উঠতে পারে। অপ্রয়োজনীয় মার্কিন শুল্ক আরোপের প্রতিক্রিয়ায় নিঃসন্দেহে পালটা শুল্ক আরোপ হবে। এর ফলে মার্কিন ভোক্তাদের আরও বেশি দাম দিয়ে ইউরোপীয় পণ্য কিনতে হবে। এর ফলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে এবং মুদ্রাস্ফীতিও বৃদ্ধি পাবে।
সূত্র : ডয়চে ভেলে।
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত