সম্প্রতি ইউরোপজুড়ে বয়ে যাওয়া এক ভয়াবহ তাপপ্রবাহে অন্তত ২৩০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে উঠে এসেছে একটি নতুন গবেষণা। এই মৃত্যুর মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ প্রায় ১,৫০০ জনের মৃত্যু সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সংঘটিত হয়েছে বলে গবেষণায় বলা হয়েছে।
গবেষণাটি ১২টি ইউরোপীয় শহর নিয়ে পরিচালিত হয়েছে, যেখানে একত্রে ৩ কোটিরও বেশি মানুষের বসবাস। এসব শহরের মধ্যে রয়েছে বার্সেলোনা, মাদ্রিদ, লন্ডন ও মিলান। গবেষণায় দেখা গেছে, এই শহরগুলোতে তাপপ্রবাহের তীব্রতা মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়েছে।
তাপপ্রবাহটি ২৩ জুন থেকে ২ জুলাই পর্যন্ত স্থায়ী ছিল, যেখানে স্পেনের কিছু অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করে। ফ্রান্সের বিভিন্ন এলাকায় ভয়াবহ দাবানলও দেখা দেয় এই সময়ে। এই সময়কালেই এসব শহরে তাপ-সম্পর্কিত কারণে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটে।
গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক ও সুইজারল্যান্ডের পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের অন্তত এক ডজন গবেষক। তারা দীর্ঘদিনের স্বাস্থ্যসংক্রান্ত তথ্য, আবহাওয়ার তথ্য এবং পরিসংখ্যানগত মডেল ব্যবহার করে মৃত্যুর সংখ্যা নির্ধারণ করেন।
ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের গবেষক বেন ক্লার্ক বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন আবহাওয়াকে উল্লেখযোগ্যভাবে গরম করে তুলেছে, যা আরও বিপজ্জনক পরিস্থতি তৈরি করছে। গবেষকরা বলেন, যদি পৃথিবী আগের মতো স্বাভাবিক উষ্ণতায় থাকত, তাহলে এই তাপপ্রবাহের তীব্রতা ২ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম হতো।
তাঁরা আরও জানান, মাত্র ২ বা ৪ ডিগ্রি অতিরিক্ত তাপমাত্রাই বহু মানুষের জন্য জীবন-মরণের পার্থক্য তৈরি করে দেয়। এই অতিরিক্ত তাপের কারণে বয়স্ক, অসুস্থ, শিশু, খোলা জায়গায় কাজ করা শ্রমিক এবং গৃহহীনদের মধ্যে মৃত্যু ঝুঁকি মারাত্মকভাবে বেড়ে যায়।
তাপপ্রবাহের প্রভাব নগর এলাকায় আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। শহরাঞ্চলে পিচঢালা রাস্তা, দালানকোঠা ও অন্যান্য কাঠামো তাপ শোষণ করে রাখে, ফলে শহরগুলো গ্রামীণ এলাকার তুলনায় অনেক বেশি উত্তপ্ত হয়। এই তাপ ধরে রাখার প্রবণতাই মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
বেশিরভাগ তাপ-সম্পর্কিত মৃত্যু ঘটে বাড়ির ভেতরে বা হাসপাতালে, যা জনসাধারণের চোখের আড়ালে থেকে যায় এবং সাধারণত সরকারি পরিসংখ্যানে ধরা পড়ে না। তাই গবেষকরা বলছেন, সরকারিভাবে প্রকাশিত চূড়ান্ত মৃত্যু পরিসংখ্যান পেতে কয়েক সপ্তাহ লেগে যেতে পারে।
ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের আরেক গবেষক গ্যারিফ্যালোস কনস্টানটিনৌডিস বলেন, তাপপ্রবাহকে নীরব ঘাতক বলা হয়। অধিকাংশ মৃত্যু চোখের আড়ালে ঘটে এবং রিপোর্ট করা হয় না।
এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস জানিয়েছে, ২০২৫ সালের জুন ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ গরমের মাস। ২০২৪ ও ২০২৩ সালের পরই এটি অবস্থান করছে। তারা জানিয়েছে, পশ্চিম ইউরোপে এবার ছিল সর্বোচ্চ উষ্ণ জুন মাস, যেখানে অনেক অঞ্চলে ‘বিষাক্ত গরমের চাপ’ অনুভূত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, তাপপ্রবাহ চলাকালীন দক্ষিণ ইউরোপের অনেক এলাকায় “ট্রপিক্যাল নাইট” দেখা গেছে – অর্থাৎ এমন রাত, যখন তাপমাত্রা এতটাই বেশি থাকে যে শরীর স্বাভাবিকভাবে ঠান্ডা হয়ে বিশ্রাম নিতে পারে না। ফলে দীর্ঘস্থায়ী তাপজনিত স্ট্রেস মানুষের মৃত্যু ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
এর আগেও ইউরোপের বিভিন্ন স্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ২০২৩ সালে এক গবেষণায় জানায়, সে বছর ইউরোপজুড়ে প্রায় ৬১ হাজার মানুষ তাপপ্রবাহে প্রাণ হারিয়েছিলেন। এটি প্রমাণ করে যে, বিভিন্ন দেশের প্রস্তুতি ও ব্যবস্থা এই দুর্যোগ মোকাবেলায় যথেষ্ট নয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপপ্রবাহের সংখ্যা, তীব্রতা ও ব্যাপ্তি সবকিছুই বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানীরা ও জলবায়ু বিশ্লেষকরা সতর্ক করছেন–তাপপ্রবাহের মতো ঘটনা ভবিষ্যতে আরও ঘন ঘন দেখা দেবে, এবং আরও বেশি সংখ্যক মানুষ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোর প্রতি দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা, যাতে শহরাঞ্চলে তাপপ্রবাহ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলা যায় এবং জনগণকে সচেতন করা যায়।
সূত্র: আল জাজিরা
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল