শিরোনাম
১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০৫:০৬

ইসলামী অর্থনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

মুফতি হুমায়ুন কবির খালভি

ইসলামী অর্থনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

গোটা বিশ্বে ইসলামী অর্থনীতির গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। অমুসলিমদের মধ্যেও এটা নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এখানে ইসলামী অর্থনীতির পরিচয় ও উদ্দেশ্য তুলে ধরা হল-

ইসলামী অর্থনীতির পরিচয়: ইসলামী অর্থনীতির আরবি প্রতিশব্দ ‘ইকতিসাদ’। শব্দটি ‘কাসদ’ থেকে নির্গত। এর অর্থ হলো রাস্তা সঠিক ও সোজা হওয়া। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘সরল পথ আল্লাহর কাছে পৌঁছায়।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৯)

অন্য আয়াতে এসেছে, ‘তুমি পদচারণে মধ্যবর্তিকা অবলম্বন করবে এবং তোমার কণ্ঠস্বর নিচু রাখবে। স্বরের মধ্যে গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।’ (সুরা : লুকমান, আয়াত : ১৯)

আর জীবিকার ক্ষেত্রে ‘কাসদ গ্রহণ’ অর্থ অতিরিক্ত ও অপ্রতুল খরচ না করা। কোনো বিষয়ে কাসদ গ্রহণ অর্থ তাতে সীমা লঙ্ঘন না করা। তাই ইকতিসাদ শব্দের অর্থে দুটি বিষয় থাকে। একদিকে ইফরাত বা অতিরিক্ত, অন্যদিকে তাফরিত বা অতিকমতি। (লিসানুল আরব, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৩৬৪২)

ড. মাহমুদ আবদুর রহমান বলেন, ইকতিসাদ শব্দটি কাসদ থেকে নির্গত। এর অর্থ মধ্যমপন্থা ও সঠিক পথ তালাশ করা। ইসলামী আইনজ্ঞরা ইকতিসাদ শব্দকে মধ্যমপন্থা অর্থে ব্যবহার করেন। (মুজামুল মুসাতালাহাত ওয়াল আলফাজিল ফিকহিয়্যা, পৃষ্ঠা ২৬০)

তাই ইকতিসাদ শব্দটির অর্থ নিম্নরূপ : 

(১) ইসতিকামা : বলা হয়ে থাকে, সে মুসতাকিম তথা তার কাজে সঠিক অবস্থায় আছে।

(২) ইসরাফের বিপরীত। অর্থাৎ সে ইসরাফমুক্ত তথা খরচে মধ্যমপন্থা গ্রহণ করেছে। বেশি-কম করেনি। (তাজুল আরুস মিন জাওয়াহিরিল কামুস, খণ্ড ৯, পৃষ্ঠা ৩৬)

ইমাম আহমদ (রহ.) বর্ণনা করেন, আবদুল্লাহ বিন মাসউদ থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি মধ্যমপন্থা গ্রহণ করবে সে অভাবী হয় না।’ (আল মুসনাদ, হাদিস : ৪২৬৯)

৩. সংকল্প।

৪. দৃষ্টি আকর্ষণ।

৫. মধ্যমপন্থা। মধ্যমর্যাদার লোক বলতে সেসব মানুষের কথা বলা হয়, যাদের মর্যাদা নবী (সা.) ও ইমামদের নিচে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তবে তাদের কেউ নিজের প্রতি অত্যাচারী, কেউ মধ্যপন্থী এবং কেউ আল্লাহর ইচ্ছায় কল্যাণ কাজে অগ্রগামী। এটাই মহা অনুগ্রহ।’ (সুরা : ফাতির, আয়াত : ৩২)

ইজ বিন আবদুস সালাম বলেন, ইকতিসাদ হলো দুই স্তরের মধ্যস্তর। কেননা, এর স্তর তিনটি—এক. কল্যাণ অর্জনে কমতি করা। দুই. কল্যাণ অর্জনে সীমা লঙ্ঘন করা। তিন. উভয়ের মধ্যস্তর। তাই কমতি ও সীমা লঙ্ঘন খারাপ। আর উত্তম পথ হলো এই দুয়ের মধ্যস্তর। যেকোনো বিষয়ে মধ্যপন্থা উত্তম। (মুজামুল মুসাতালাহাত ওয়াল আলফাজিল ফিকহিয়্যা, পৃষ্ঠা ২৬০)

পরিভাষায় ‘অর্থনীতি হলো ওই শাস্ত্র, যার মধ্যে বাহ্যিকভাবে উৎপাদন ও বণ্টন নিয়ে আলোচনা করা হয়।’ (আল মুজামুল ওয়াসিত, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৭৩৮) ড. আহমদ মুখতার বলেন, ‘অর্থনীতি ওই শাস্ত্রকে বলা হয়, যাতে উৎপাদন, বণ্টন ও ব্যয় নিয়ে আলোচনা হয়।’ (মুজামু লুগাতিল আরবিয়্যা আল মুআসিরা, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ১৮-১৯)

ইসলামী অর্থনীতির সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে ড. মুসফির কাহতানি লেখেন, ‘ইসলামী অর্থনীতি হলো ওই সব বিধান ও নিয়মনীতি, যা দ্বারা সম্পদ উপার্জন, ব্যয় ও বৃদ্ধি ব্যবস্থাপনা করা হয়।’ (আন নিজামুল ইকতিসাদি ফিল ইসলাম, পৃষ্ঠা ১)

তাই ইসলামী অর্থনীতি হল, সম্পদ উপার্জনের ব্যবস্থাপনা ও শরয়ি নিয়মনীতি মোতাবেক তা বণ্টন ও খরচ করার পদ্ধতি। কারণ ইসলামী অর্থনীতিতে সম্পদ উপার্জনের নির্দিষ্ট নিয়মনীতি আছে, তেমনি সম্পদ কোন কোন খাতে ব্যবহার করা হবে এবং কিভাবে কী পরিমাণ ব্যয় করা হবে—সব বিস্তারিতভাবে বর্ণিত আছে। তেমনি কত সম্পদ জমা রাখতে পারবে বা কখন গুদামজাত ও সঞ্চয় করতে পারবে, আর কোন বস্তু জমা রাখতে পারবে সব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি আছে। সব কোরআন ও সুন্নাহ মতে হতে হবে।

ইসলামী অর্থনীতির লক্ষ্যবস্তু

ইসলামী শরিয়াহর উদ্দেশ্যই মূলত ইসলামী অর্থনীতির উদ্দেশ্য। কেননা ইসলামী অর্থনীতি ইসলামী শরিয়াহর একটি শাখা। তাই ইসলামী অর্থনীতির উদ্দেশ্য হল-

ধ্বংস, মন্দা ও লোকসান থেকে মানুষের সম্পদ হেফাজত করা। তাই ইসলামে কাজ, হালাল উপার্জন এবং রিজিক তালাশকে ইবাদত ও পুণ্যের কাজ ঘোষণা করা হয়েছে। (ইলমুল মাকাসিদিশ শরিয়াহ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৭৫)

মানুষের মধ্যে প্রচলিত ইজারা ও সব ধরনের লেনদেন বৈধ পদ্ধতিতে করার অনুমোদন দেওয়া। সুদ, ঘুষ, ডাকাতি, চুরি ও অবৈধ পন্থায় মানুষের সম্পদ কুক্ষিগত করা হারাম করা এবং এর জন্য শাস্তি, হুদুদ, তাজির ইত্যাদি অনুমোদন দেওয়া।

সম্পদ অপচয়, নষ্ট ও কৃপণতা হারাম ঘোষণা করা। সম্পদ বাতিল, ধ্বংস ও নষ্ট করার কারণে জরিমানা করা। সম্পদ রক্ষা করা, তা হেফাজতের জন্য যুদ্ধ করার বৈধতা প্রদান করা। যদিও সে দুর্বল হয়। বিভিন্ন চুক্তি, এর সাক্ষী, বন্ধক, সালাম পদ্ধতিতে লেনদেন বৈধ প্রদান করা ও সব ধরনের প্রতারণা ও অজ্ঞতাপূর্ণ লেনদেনকে হারাম ঘোষণা করা।

সাক্ষ্যের মাধ্যমে ঋণ অনুমোদন দেওয়া, তা লিখে রাখা এবং তা পূরণ করতে উৎসাহিত করা। উৎপাদনবিহীন সম্পদ গুদামজাত হারাম করা। অর্থ জালিয়তি, মিথ্যার আশ্রয় এবং রাজনৈতিক, বৈজ্ঞানিক, প্রশাসনিক ও ধর্মীয় শক্তি দ্বারা প্রভাব বিস্তার রোধ করা। পাশাপাশি প্রতারণা ও ধোঁকাসহ সব ধরনের বাতিল লেনদেনকে হারাম ঘোষণা করা। (ইলমুল মাকাসিদিশ শরিয়াহ খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৭৫)

আবদুল্লাহ বিন আবদুল মুহসিন তুর্কি বলেন, আর্থিক লেনদেন বলতে ঋণ, সালাম, হাওয়ালা, কাফালা, সন্ধি, ওকালাহ, মুদারাবা, অংশীদারি কারবার, ইজারা, ধার নেওয়া, আমানত, শুফা, অনাবাদি জমিন আবাদ করা, ওয়াকফ, লুকতা ও হেবা ইত্যাদি বোঝানো হয়। (দিরাসাহ ফি তারিখিহি ওয়া সিমাতিহি ওয়া আশহুরু আলামিহি ওয়া মুয়াল্লাফাতিহি, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৩৯৪)

সারকথা হলো, আর্থিক লেনদেনের উদ্দেশ্য হলো বৈধ পদ্ধতিতে মানুষের সম্পদ হেফাজত করা, সমস্যা সমাধান করা, সামাজিক জুলুম-নির্যাতন দূর করা, উপার্জনে মানুষের হক প্রতিষ্ঠা করা এবং ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্বচ্ছ লেনদেনের ব্যবস্থা করা।

বিডি প্রতিদিন/আবু জাফর

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর