কেয়ামতের কঠিন দিন। সূর্য মাথার একেবারেই কাছে। তাপে গুনাহগারদের মগজ গলে গলে পড়ছে। নারী-পুরুষ সবাই দিগি¦দিক ছোটাছুটি করছে। কারও কোনো হুঁশ নেই। সবাই পানি পানি বলে চিৎকার করছে। এমন সময় গায়েব থেকে একজন ঘোষক বললেন, ‘আইনাল মুতাহাব্বুন?’ প্রেমিকযুগল কোথায়? সে কঠিন সময়ে কোটি কোটি মানুষ অল্প সময়ের জন্য থেমে যাবে কেননা ঘোষণাটি সাধারণ কারও নয়। স্বয়ং রাজাধিরাজ আল্লাহর ঘোষণা। প্রেমিক যুগল কোথায়? সবাই একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করবে। সবাই তো প্রেমিক। কেউ প্রেয়সীর প্রেমিক। কেউ প্রিয়ার প্রেমিক। কেউ সন্তানের প্রেমিক। কেউ মায়ের প্রেমিক। কেউ বাবার প্রেমিক। কেউ টাকার প্রেমিক। কেউ সম্পদের প্রেমিক। সবাই তো কারও না কারও কোনো না কিছুর প্রেমিক ছিল দুনিয়ার জীবনে। তখন তো মাথায় কাজ করবে না। প্রেমিক শব্দ শুনেই সবাই থমকে দাঁড়াবে। চমকে তাকাবে। ভাববে কোনো স্বস্তির ঘোষণা শোনানো হবে হয়তো। কিন্তু না। সবার ধারণার বাইরে গিয়ে আল্লাহ বলবেন, ‘লিজালালি’। আমার সন্তুষ্টির জন্য যারা একে অন্যের সঙ্গে প্রেম করেছে, ভালোবাসার খেলায় মজেছে, ফানা ফিশ শায়েখ হয়েছে, মাশুকের জন্য পাগল হয়েছে- সে প্রেমিকযুগল কোথায়?
আল্লাহ ডেকে বলবেন, ‘আইনাল মুতাহাব্বুনা লিজালি।’ ওহে দুনিয়ায় যারা আমার সন্তুষ্টির জন্য একে অন্যের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছ, প্রেমে মজেছ, ভাই পাতিয়েছ, বোন হয়েছ, আত্মীয়তা করেছ, বিকালে হাঁটতে বেরিয়েছ, দোকানে চা খেয়েছ, নদীতে সাঁতার কেটেছ, হালালভাবে ব্যবসা করেছ, মসজিদে নামাজ পড়েছ, একসঙ্গে মাহফিলে গিয়েছ, কোরআন পড়েছ, তাকওয়ার কাজে প্রতিযোগিতা করেছ, অন্যায় কাজে বাধা দিয়েছ, সংগঠন করেছ, রাজনীতি করেছ, জিহাদের ময়দানে অটল থেকেছ, কোথায় তোমরা? হাশরবাসীর সামনে ঘোষণা স্পষ্ট হয়ে গেল। সবাই বুঝে গেল দুনিয়ার সব প্রেম বৃথা হয়েছে। বাতিল হয়েছে। মুছে গিয়েছে। কেবল আল্লাহর জন্য যে প্রেম করা হয়েছে সেটাই আজ মূল্যায়ন হবে। সম্মান পাবে। শান্তি পাবে। জান্নাত পাবে। ‘আইনাল মুতাহাব্বুনা লিজালি।’ কোথায় আল্লাহর জন্য একে অপরকে ভালোবেসেছ এমন মানুষ! ঘোষণা শোনার সঙ্গে সঙ্গে একদল মানুষ আলাদা হয়ে যাবে। দুনিয়ার জীবনের কথা তাদের মনে পড়বে। আহারে! তারা তো আল্লাহর জন্য জীবন কাটিয়েছে। কত ছেলেমেয়ে অবৈধ বয়ফ্রেন্ডে-গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরেছে। তাদের কোনো বয়ফ্রেন্ড ছিল না। ছিল না কোনো গার্লফ্রেন্ড। এ জন্য ‘মোল্লা’ বলে তাদের টিটকারি দেওয়া হয়েছে। ব্যাকডেটেড বলে গালি দিয়েছে। দুনিয়ার মজা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে উপহাস করা হয়েছে। আজ আল্লাহ তাদের বাছাই করে নিয়েছেন। কেয়ামতের ময়দানে উপস্থিত লাখ লাখ মানুষ থেকে তাদের আলাদা হওয়ার জন্য আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন। তাদের কেউ ইউনিভার্সিটিতে পড়ত। দাড়ি রাখত বলে তার সঙ্গে অনেকে বন্ধুত্ব করত না। কিন্তু যার ভিতর আল্লাহর ভয় আছে এমন একজন এসে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছে। ক্যাম্পাসের মাঠে একসঙ্গে তারা কত হেঁটেছে। কত অ্যাসাইনমেন্ট তারা একসঙ্গে করেছে। আজ আল্লাহ যখন তাদের স্বর্গীয় প্রেমে মূল্যায়ন করলেন তখন তারা বাঁধভাঙা আনন্দে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। তাদের কেউ ছিলেন ব্যবসায়ী। সারা দুনিয়ার বিপক্ষে গিয়ে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। সে লড়াইয়ে কেউ সঙ্গী হয়নি। ওই বাজারে শুধু একজন নামাজি মানুষ ছিল যে বলেছে ভাই, আমি তোমার সঙ্গে আছি। আমিও সিন্ডিকেট নামের এই মানুষ ঠকানো ব্যবস্থা ভেঙে দিতে চাই। বাজারে সবাই তাদের হুমকি দিয়েছে। টিটকারি দিয়েছে। ব্যবসা বন্ধ করার জন্য যা কিছু করার লাগে সব করেছে। কিন্তু ওই দুই ব্যবসায়ী একজন আরেকজনকে ছাড়েননি। কারণ তাদের সম্পর্ক হয়েছে আল্লাহর জন্য। মানুষের কষ্ট দূর করা ছিল তাদের নিয়ত। এই ঘোষণা শুনে আনন্দে কাঁদতে শুরু করলেন তারা। এমন সময় আল্লাহ ঘোষণা করে বলবেন, ‘উজিললুহুম ফি জিললি। ওরে আমার পাগলেরা! কাঁদার দিন শেষ দুনিয়ায় একে অন্যকে ভালোবেসে আমার জন্য, আজ এ কঠিন দিনে আমি তোমাদের ছায়া দেব। তোমাদের মায়া দেব। তোমাদের আদর করব। দুনিয়ায় কত কষ্ট করেছ তোমরা আমার সন্তুষ্টির জন্য। চেনা নেই পরিচয় নেই, তবু কোনো আলেম দেখলেই তোমরা ভালোবাসতে আমার খুশির জন্য। ভালোবাসতে তালেবে এলেমদেরও। নিজে ভালো খেতে পারতে না। কিন্তু মসজিদের হুজুরের খাওয়া যেদিন ছিল, আলেমকে যেদিন দাওয়াত করতে সেদিন ধারদেনা করে হলেও ভালো খাবারের আয়োজন করেছ। তোমার প্রবৃত্তি এক কথা বলত, তোমার পীর বলত কোরআনের কথা, তুমি পীরকে ভালোবেসে তার কথা শুনেছ, পীরের প্রেমে নিজেকে ফানা করে দিয়েছ। আসো তোমরা আমার ছায়ায় আসো। ‘ইয়াওমা লা জিললা ইল্লা জিল্লি।’ আজ আমার ছায়া ছাড়া কোনো ছায়া নেই। সুবহানাল্লাহ। পাঠক! আসুন আমরা মানুষকে ভালোবাসি আল্লাহর জন্য। ভালো যেহেতু বাসতেই হবে, কেন আল্লাহর জন্য বাসব না। আল্লাহর জন্য সম্পর্ক করতে পারলে দুনিয়াতে কোনো মূল্যায়ন হোক না বা হোক, কেয়ামতের দিন ঠিকই আল্লাহ মূল্যায়ন করবেন।
লেখক : প্রিন্সিপাল, সেইফ এডুকেশন ইনস্টিটিউট পীর সাহেব, আউলিয়ানগর
বিডি প্রতিদিন/এমআই