‘সাবিঈ’ একটি পুরোনো ধর্ম। শব্দটি আরবি অভিধানে এক ধর্ম থেকে অন্য ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। (লিসানুল আরাব, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১০৭)
এ ধর্মের অনুসারীদের বলা হয় ‘সাবিঈন’। তাদের এ নামে নামকরণের কারণ হলো, এরা আহলে কিতাব (আসমানি কিতাবের অনুসারী) থেকে বেরিয়ে এসে নতুন ধর্মমত উদ্ভাবন করেছে। [আস-সিহাহ (বৈরুত : দারুল মারিফাহ, ২০০৭ খ্রি.), পৃষ্ঠা-৫৭৭)]
এ ধর্মাবলম্বীরা মনে করে যে, তারা নুহ (আ.)-এর ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ইসলামের বহু আগে থেকে এ ধর্মের অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যায়। (আস-সাহারানি, আস-সাবিয়া, পৃষ্ঠা-৯)
পবিত্র কোরআনে আহলুল কিতাব ও মুমিনদের সঙ্গে তিনটি স্থানে সাবিঈদের কথা উল্লিখিত হয়েছে।
যেমন আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় যারা ইমান এনেছে, যারা ইহুদি হয়েছে এবং খ্রিষ্টান ও সাবিঈন যারাই আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ইমান আনে এবং সৎকর্ম করে, তাদের জন্য পুরস্কার আছে তাদের প্রতিপালকের পুরস্কার। তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ৬২)
আল্লাহ আরো বলেন, ‘মুমিন, ইহুদি, খ্রিষ্টান ও সাবিঈদের মধ্যে কেউ আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ইমান আনলে এবং সৎ কাজ করলে তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।’ (সুরা : আল-মায়িদা, আয়াত : ৬৯)
আল্লাহ অন্যত্র বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা ইমান এনেছে এবং যারা ইহুদি হয়েছে, যারা সাবিঈ, খ্রিষ্টান ও অগ্নিপূজক এবং যারা মুশরিক হয়েছে, নিশ্চয় আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবেন। আল্লাহ সব কিছুর সম্যক প্রত্যক্ষকারী।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ১৭)
উপযুক্ত তিনটি আয়াতে সাবিঈদের কথা বলা হয়েছে। এই সাবিঈ কারা? তাদের পরিচয় কী?
বিখ্যাত মুফাসসির ইমাম আল-কুরতুবি (রহ.) লিখেছেন, সাবিঈরা আহলুল কিতাবদের অন্তর্ভুক্ত নয়। তারা আলাদা ধর্মমতের অনুসারী।
তাবিঈ আল-সুদ্দি (রহ.)-এর মতে, এরা আহলুল কিতাবদের একটি অংশ।
ইবনুল মুনজির (রহ.) বলেন, এরা আহলুল কিতাবদের অন্তর্ভুক্ত।
সুতরাং এদের জবাইকৃত প্রাণীর গোশত খাওয়া বৈধ এবং তাদের বিবাহ করাও বৈধ। এটি ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর অভিমত। (আল জামিলি আহকামিল কোরআন, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪৩৪-৪৩৫)
শিআ মুফাসসির আল-কাশানির মতে, সাবিঈরা নিজেদের আল্লাহর দ্বিনের প্রতি অনুরক্ত মনে করলেও তারা মিথ্যাবাদী। তারা আহলুল কিতাবের মধ্যে গণ্য নয়, বরং তারা নক্ষত্র পূজারি। [ফায়াদ আল-কাশানি, কিতাবুস সাফি ফি তাফসিরিল কোরআন, ১ম খণ্ড (তেহরান : আল-মাকতাবাতুল ইসলামিয়্যাহ, ১৩৯৩ হি.), পৃষ্ঠা-৯৮]
সাবিঈ ধর্ম পুরোনো হলেও এদের আকিদা বিশ্বাসে দ্বিত্ববাদ পরিলক্ষিত হয়। তারা আল্লাহর একত্ববাদের কথা বললেও সৌরপূজা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের অঙ্গ হিসেবে পরিগণিত। (আল ফাদল ইবনুল হাসান আল-তাবরিসি, জাওয়ামিউল জাময়ি ফি তাফসিরিল কোরআনিল মাজিদ, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬৩)
অতীত ও বর্তমান সাবিঈ সম্প্রদায়ের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করলে এদের কয়েকটি উপদলে ভাগ করা যায়। তাদের একদল নিরেট তাওহিদপন্থি না হলেও তাওহিদের কাছাকাছি। এ জন্যই আল-কোরআনে আহলুল কিতাবদের সঙ্গে তাদের উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামী আইনজ্ঞরা তাদের বেশিরভাগকে আহলুল কিতাবদের অনুরূপ মনে করে শান্তিচুক্তিসহ তাদের ওপর জিজিয়া রহিত করার হুকুম দিয়েছেন। তবে তাদের কন্যাদের বিয়ে করা যাবে না এবং তাদের জবাইকৃত প্রাণীর গোশত আহার করা যাবে না বলে ফতোয়া দিয়েছেন। (আস-সাহারানি, আস-সাবিয়া, পৃষ্ঠা-১৫)
সাবিঈদের আঞ্চলিক অবস্থান
বর্তমানে ইরাকে বেশিরভাগ সাবিঈর আবাসস্থল। ইরাকের ওয়াসিত ও বসরার মধ্যবর্তী প্রশস্ত অঞ্চলজুড়ে সাবিঈরা বসবাস করে। ঐতিহাসিকরা এ অঞ্চলকে তাদের আদি নিবাস হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সাবিঈরা সব সময় সমুদ্র উপকূলবর্তী ও নদীর তীরবর্তী স্থান বসবাসের জন্য উপযোগী স্থান মনে করে। কারণ নদী বা সমুদ্রের প্রবহমান পানির সঙ্গে তাদের দ্বিনি বিষয় বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া জড়িত আছে। তাই ইরাকের দজলা ও ফোরাত নদীর তীরবর্তী এলাকায় তাদের বসবাস করতে দেখা যায়।
জানা যায়, গোটা বিশ্বে সাবিঈদের সংখ্যা প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার। এদের বেশির ভাগ ইরাকে বসবাস করে। বসরার অনতিদূরে আহওয়াজে এদের অনেককে বসবাস করতে দেখা যায়। আর যারা বাগদাদ নগরীতে বাস করে তাদের বেশিরভাগ রৌপ্যের কারখানায় কাজ করে। [ড. সাদুদ্দিন ইবরাহিম, তাআম্মুলাত ফি মাসআলাতিল আকাল্লিয়াত (কায়রো : মারকাজু ইবন খালদুন, ১৯৯২ খ্রি.) পৃষ্ঠা-১০৬]
ইরাক ও ইরানে এরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে নিরাপত্তার সঙ্গে বসবাস করছে। এসব অঞ্চলে তারা স্বাধীনভাবে নিজেদের ধর্মমত ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করছে। (আস-সাহমারানি, আস-সাবিয়াহ, পৃষ্ঠা-২৫-২৬)
বিডি প্রতিদিন/কেএ