মানবসমাজে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অন্যতম ভিত্তি হলো ক্রয়-বিক্রয় ও সেবা আদান-প্রদান। এ ক্ষেত্রে চাহিদা ও জোগান নীতি একটি স্বাভাবিক এবং কার্যকর প্রক্রিয়া। ইসলাম মানুষের অর্থনৈতিক জীবনকে স্বচ্ছ, ন্যায়সংগত ও ভারসাম্যমূলক করার জন্য বাজারব্যবস্থার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে উদ্বুদ্ধ করে। কৃত্রিমভাবে দাম বাড়ানো, জবরদস্তি করে মূল্য নির্ধারণ কিংবা দালালির মাধ্যমে বাজারে অস্বাভাবিকতা সৃষ্টি করা ইসলামে নিষিদ্ধ।
কোরআন ও হাদিসে চাহিদা ও জোগান নীতির মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে বাজারদর নির্ধারণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এর ফলে একদিকে যেমন বাজারে স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচার বজায় থাকে, অন্যদিকে রিজিকের প্রবাহও স্বাভাবিক থাকে।
১. চাহিদা ও জোগান নীতির প্রয়োগ
বাজারদর নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার বল বা চাপ প্রয়োগ ইসলামে কাম্য নয়; বরং ইসলাম বাজারের শক্তি অর্থাৎ চাহিদা ও জোগান নীতিকে অবাধ ও কার্যকর করার মাধ্যমে স্বাভাবিক বাজার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে উৎসাহিত করে। মহান আল্লাহ পৃথিবীতে অর্থনৈতিকভাবে সবাইকে সমান করেননি। একজন বিক্রি করে, আরেকজন ক্রয় করে। একজন সেবা দেয়, আরেকজন তা গ্রহণ করে। কেনাবেচার ক্ষেত্রে ক্রেতার প্রয়োজন হলো চাহিদা আর বিক্রেতার আয়োজন হলো জোগান। সেবা আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে সেবাগ্রহণকারী সেবার চাহিদা আর সেবাপ্রদানকারী সেবার জোগান।
চাহিদা ও জোগানের পরস্পরের মিলনে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ বাজার ব্যবস্থাপনা তৈরি হয়। ফলে বাজারদরও নির্ধারণ হয়ে যায়। চাহিদা ও জোগান নীতি যতটা অবাধ ও কার্যকর হবে, বাজারদরও ততটা সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। কোরআন থেকেই চাহিদা ও জোগান নীতির ধারণা পাওয়া য়ায়।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারা কি তোমার প্র্রতিপালকের করুণা বণ্টন করে? আমিই তাদের মধ্যে তাদের জীবিকা বণ্টন করি পার্থিব জীবনে এবং একজনকে অপরের ওপর মর্যাদায় উন্নীত করি, যাতে একে অপরের দ্বারা কাজ করিয়ে নিতে পারে; এবং তারা যা জমা করে তা হতে তোমার প্র্রতিপালকের অনুগ্রহ উত্কৃষ্টতর। ’ (সুরা : জুখরুফ, আয়াত : ৩২)।
২. চাহিদা ও জোগান নীতির স্বাভাবিক
প্রবাহ : রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে গ্রাম্য লোকেরা তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রয়ের জন্য শহরে নিয়ে এলে কিছু শহরবাসী তাদের বিক্রয় করতে নিরুৎসাহিত করত এবং নিজেরা তৃতীয়পক্ষ হয়ে বিক্রি করার দায়িত্ব নিত। অনেক সময় রাস্তায় গ্রাম্য লোকদের থেকে পণ্য ক্রয় করে বাজারজাত করত। তাদের বাজার পর্যন্ত পৌঁছতেই দিত না। রাসুল (সা.) শহরবাসীদের এমন করতে নিষেধ করেছেন। কারণ গ্রাম্য লোক সাধারণত বাজারদর ভালো জানে না। এ ক্ষেত্রে শহরবাসী তৃতীয়পক্ষ হিসেবে দায়িত্ব নিলে অথবা গ্রাম্য লোকদের শহরের বাজারে আসতে না দিলে বাজারের শক্তি অর্থাৎ চাহিদা ও জোগান নীতি বাধাগ্রস্ত হয়ে বাজারদর বেড়ে যেতে পারে। এ ছাড়া রিজিকের স্বাভাবিক প্রবাহ তথা বাজারে স্বাভাবিক লেনদেন বাধাগ্রস্ত হয়। কেউ সরাসরি কেনাবেচা করলে কারো ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে না। ইসলাম চায় বাজারে স্বচ্ছতা থাকুক এবং রিজিকের স্বাভাবিক প্রবাহ চলমান থাকুক, যেন কেউ সুযোগ নিয়ে অন্যকে ঠকাতে না পারে। তাই অপ্রয়োজনীয় দালালি বা দাম বাড়ানোর কৌশল অবলম্বন নিষিদ্ধ। জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, শহরের লোক গ্রামের লোকের পক্ষ হয়ে বিক্রয় করবে না। মানুষদের মুক্ত ছেড়ে দাও। আল্লাহ একে অপরের মাধ্যমে রিজিক প্রদান করেন। (মুসলিম, হাদিস : ১৫২২)।
এভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তির অনুপ্রবেশ নাকচ করে দিয়েছেন, যেন চাহিদা ও জোগানের সঠিক প্রবাহ অব্যাহত থাকে। গ্রাম্য ব্যক্তি যখন সরাসরি বাজারে কোনো পণ্য বিক্রয় করবে তখন সে তার সমীচীন লাভ নিয়েই বিক্রয় করবে। তার যেহেতু দ্রুত ফিরে যেতে হবে তাই কুক্ষিগত করার কোনো সুযোগ রাখবে না। তার নিজের বাজারে যাওয়ার দ্বারা চাহিদা ও জোগানের এমন মিলন হবে, যা স্বাভাবিক মূল্য নির্ধারণে সহায়ক হবে।
৩. রাষ্ট্রীয়ভাবে মূল্য নির্ধারণ না করা
চাহিদা ও জোগানের স্বাভাবিকতায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করে, বরং এটিকে অবাধ ও গতিশীল করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) চাহিদা ও জোগানের সৃষ্টিগত নীতিকে চালু রাখার ব্যবস্থা করেছেন। এ জন্য নবীজির কাছে বাজারে বিক্রয়যোগ্য পণ্যের মূল্য সরকারিভাবে নির্ধারণ করে দেওয়ার আহবান জানালে তিনি তা করেননি; বরং তিনি চাহিদা ও জোগানের সৃষ্টিগত নীতির প্রতি জোর দিয়েছেন। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে একবার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে লোকেরা বলতে লাগল, হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের জন্য দ্রব্যমূল্য বেঁধে দিন। তিনি বলেন, আল্লাহ তাআলাই মূল্য নির্ধারণ করে থাকেন, তিনিই নিয়ন্ত্রণকারী, অপ্রশস্তকারী, প্রশস্তকারী ও রিজিক দানকারী। আমি আমার প্রতিপালকের সঙ্গে এমন অবস্থায় মিলিত হতে চাই যে তোমাদের কোনো লোক যেন এ দাবি করতে না পারে (আমার বিরুদ্ধে) যে তার জান-মালের ওপর আমি হস্তক্ষেপ করেছি। নিশ্চয়ই আল্লাহ মূল্য নির্ধারণকারী, তিনিই পণ্যের জোগান বৃদ্ধি ও হ্রাসকারী এবং রিজিকদাতা। (তিরমিজি, হাদিস : ১৩১৪)।
অর্থাৎ বাজারে কৃত্রিম হস্তক্ষেপ করে দাম নির্ধারণ করা সঠিক নয়। আল্লাহই বাজারের স্বাভাবিক ওঠানামার নিয়ন্ত্রক। মহান আল্লাহকে মূল্য নির্ধারক সাব্যস্ত করার প্রকাশ্য উদ্দেশ্য হাদিসের পরের অংশে বলা হয়েছে যে আল্লাহ চাহিদা ও জোগানের সৃষ্টিগত নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন; যা দ্বারা মূল্যও সৃষ্টিগতভাবে নির্ধারণ হয়। এই সৃষ্টিগত নীতি বর্জন করে কৃত্রিমরূপে মূল্য নির্ধারণ গ্রহণযোগ্য নয়।
পরিশেষে বলা যায়- ইসলাম বাজারব্যবস্থাকে স্বাভাবিকভাবে চলমান রাখতে চায়; যেখানে কৃত্রিম প্রভাব বা রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ অপ্রয়োজনীয়। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শিক্ষায় প্রতিফলিত হয়েছে যে আল্লাহই প্রকৃত মূল্য নির্ধারক এবং তিনিই জোগান ও চাহিদার ভারসাম্যের মাধ্যমে মানুষের রিজিক বণ্টন করেন। তাই ইসলামী অর্থনীতি বাজারে জবরদস্তি ও প্রতারণা পরিহার করে স্বচ্ছতা, ন্যায়বিচার ও প্রাকৃতিক প্রবাহ বজায় রাখাকে মৌলিক নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে। এভাবেই চাহিদা ও জোগান নীতি ইসলামী অর্থনীতিতে ন্যায়সংগত ও ভারসাম্যমূলক বাজারদর নিশ্চিত করে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ