আজকের পৃথিবী এক অদ্ভুত রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তথ্য-প্রযুক্তির ঝলমলে দুনিয়া মানুষকে দিয়েছে দ্রুত যোগাযোগের সুযোগ, দিয়েছে অসীম সম্ভাবনার দ্বার। আর স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য হিসেবে মানুষের মধ্য রয়েছে প্রভাবিত হওয়ার বিপুল সম্ভাবনা। যুগে যুগে পাল্টেছে সেই প্রভাবিত হওয়ার উপাদান, কখনো কবিরা ছিলেন সমাজের রোল মডেল, কখনো রাজনীতিবিদরা, কখনো লেখক বা বুদ্ধিজীবীরা।
আজকের ডিজিটাল যুগে সেই জায়গায় এসেছে ইন্টারনেট তারকা বা ইনফ্লুয়েন্সাররা। ইনফ্লুয়েন্সার হলেন এমন ব্যক্তি যিনি অন্যদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারেন, তাঁদের অনুসারীরা কোনো পণ্য বা সেবা গ্রহণ কিংবা ব্যক্তিগত জীবনাচারে তাঁদের দ্বারা প্রভাবিত হয়। এই প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ইন্টারনেট সেলিব্রিটি হিসেবেও পরিচিত। সময় অবস্থানের ভিন্নতায় তাঁরা প্রভাব বিস্তার করেন মানুষের চিন্তা, জীবনধারা, পোশাক-পরিচ্ছদ, এমনকি বিশ্বাস ও মূল্যবোধের ওপরও।
কয়েক মিনিটের ভিডিও কিংবা কিছু ছবির মাধ্যমে তাঁরা হয়ে উঠছেন কোটি মানুষের অনুকরণীয়। আধুনিক তরুণ-তরুণীরা তাঁদের সাজসজ্জা, কথাবার্তা, এমনকি বিশ্বাস-মূল্যবোধও লালন করেন তাঁদের মতো করে। নতুন এই সংস্কৃতির যেমন রয়েছে উজ্জ্বল দিক, তেমনি আছে এর অন্ধকার দিকও। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে এই বাস্তবতাকে উপেক্ষা করা যায় না। কারণ ইসলাম জীবনঘনিষ্ঠ, সময়োপযোগী ও পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। যেকোনো নতুন সামাজিক প্রবণতার আলো-অন্ধকার উভয় দিক নিয়েই ইসলামের আলোচনা জরুরি।
খ্যাতির আকাঙ্ক্ষা ও কোরআনের দৃষ্টিভঙ্গি
মানুষ স্বভাবতই সম্মান, মর্যাদা ও পরিচিতি পেতে চায়। কিন্তু ইসলামে খ্যাতি অর্জনের উদ্দেশ্য হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি। আল্লাহ তাআলা বলেন, আখিরাতের ঘর আমি তাদের জন্য বানিয়ে রেখেছি; যারা পৃথিবীতে বড়াই করতে চায় না, ফ্যাসাদও করে না।
আর মুত্তাকিদের জন্যই শুভ পরিণাম। (সুরা : কাসাস, আয়াত : ৮৩)
এখানে স্পষ্টতই বলা হচ্ছে যে খ্যাতি বা প্রভাব যেন অহংকার, বড়াই কিংবা অন্যকে বিভ্রান্ত করার জন্য না হয়। অথচ আজকের অনেক ইনফ্লুয়েন্সারের মূল চালিকাশক্তি হলো ‘লাইক, ফলোয়ার, সাবস্ক্রাইবার’ সংখ্যা। আর অনেকেই তা অর্জনের জন্য এমন কোনো ছলচাতুরী বা অন্যায় পথ নেই যা অবলম্বন করেন না। তাঁদের সাফল্যের মানদণ্ড হয় মানুষের করতালি, অথচ ইসলামে আসল মর্যাদা মাপা হয় তাকওয়ার মাধ্যমে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত সে-ই, যে সবচেয়ে বেশি মুত্তাকি।’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১৩)
হাদিসে খ্যাতি-লোভের সতর্কতা
রাসুলুল্লাহ (সা.) স্পষ্টভাবে খ্যাতি-লোভের ক্ষতির কথা বলে ঘোষণা করেছেন, ‘যে ব্যক্তি খ্যাতির জন্য আমল করে, আল্লাহ তাকে লাঞ্ছিত করবেন।’
(মুসলিম, হাদিস ২৯৮৬)
তিনি আরো বলেছেন, ‘দুটি ক্ষুধার্ত নেকড়ে বাঘকে ছাগলের পালে ছেড়ে দেওয়া হলে পরে তা যতটুকু না ক্ষতিসাধন করে, কারো সম্পদ ও প্রতিপত্তির লোভ এর চেয়ে বেশি ক্ষতিসাধন করে তার ধর্মের।’ (তিরমিজি, হাদিস ২৩৭৬)
এই হাদিসগুলো বর্তমান ইনফ্লুয়েন্সার সংস্কৃতির বিপদকে যেন সামনে এনে দেয়। কারণ অধিকাংশ ইনফ্লুয়েন্সার জনপ্রিয়তার জন্য শরিয়তবিরোধী কাজেও দ্বিধা করে না, অশ্লীলতা ছড়ানো, মিথ্যা প্রচার, কুৎসিত চ্যালেঞ্জ গ্রহণ ইত্যাদিতে জড়িয়ে যান।
ইসলামী স্কলারদের দৃষ্টিভঙ্গি
সমকালীন আলেমগণও এ বিষয়ে সতর্ক করেছেন। শায়খ সালেহ আল-ফাওজান বলেন, ‘খ্যাতি এমন এক পরীক্ষা, যা মানুষকে ধ্বংস করে দেয় যদি সে তার নিয়ত ও আমলকে খাঁটি না রাখে।’ (আল-মালফুযাত, খণ্ড ২, পৃ. ৪৩৭)
ইমাম ইবনে রজব হানবলী (রহ.) বলেছেন, ‘মানুষের চোখে বড় হতে চাওয়ার চেয়ে ভয়ংকর রোগ আর কিছু নেই।’ (জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম, পৃ. ১৬৫)
তাদের ভাষ্য থেকে বোঝা যায়, খ্যাতি যদি দাওয়াহ, শিক্ষা বা কল্যাণে কাজে লাগে, তবে তা প্রশংসনীয়। কিন্তু উদ্দেশ্য যদি হয় শুধু লাইক ও প্রশংসা, তবে তা আত্মার জন্য বিষ।
ইনফ্লুয়েন্সার সংস্কৃতির অন্ধকার দিক
১. অশ্লীলতা ও নগ্নতা প্রচার : বেশির ভাগ ইনফ্লুয়েন্সার দর্শক টানতে শালীনতা ভেঙে দেয়। অথচ ইসলাম স্পষ্টভাবে সতর্ক করেছে, ‘মুমিন পুরুষদের বলে দাও, তারা যেন দৃষ্টি সংযত রাখে এবং লজ্জাস্থান রক্ষা করে।’ (সুরা : নুর, আয়াত : ৩০)
২. সময় অপচয় ও মানসিক আসক্তি : ফলোয়ার বাড়ানো বা কনটেন্ট তৈরির প্রতিযোগিতা অনেক ক্ষেত্রে মানুষকে নামাজ, ইলম ও দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘দুই নিয়ামতের বিষয়ে অধিকাংশ মানুষ ধোঁকায় থাকে : স্বাস্থ্য ও অবসর সময়।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৪১২)
৪. ভুয়া জীবনধারা : ক্যামেরার সামনে ঝলমলে বিলাসী জীবন দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে হিংসা, হতাশা ও ঋণের জালে ফেলা হয়। অথচ রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের চেয়ে নিম্নস্তরের লোকদের প্রতি দৃষ্টি দাও। তোমাদের চেয়ে উঁচু স্তরের লোকদের দিকে লক্ষ করো না। কেননা আল্লাহর নিয়ামতকে তুচ্ছ না ভাবার এটাই উত্তম পন্থা।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৯৬৩)
৫. মিথ্যা সংবাদ ও গুজব ছড়ানো : কোরআন নির্দেশ দিয়েছে- ‘হে মুমিনগণ, যদি কোনো ফাসিক ব্যক্তি তোমাদের কাছে সংবাদ আনে, তবে তোমরা তা যাচাই করো।’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ৬)
কিন্তু ইনফ্লুয়েন্সাররা অনেক সময় যাচাই ছাড়াই খবর প্রচার করে, যা ফিতনা ও বিভ্রান্তি ছড়ায়।
ইতিবাচক দিকের সম্ভাবনা
তবে সব ইনফ্লুয়েন্সারই যে ক্ষতিকর, তা নয়। ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যও সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করা যায়। কোরআন-হাদিস শিক্ষার ছোট ভিডিও, বিজ্ঞান ও ইসলামের সমন্বয় নিয়ে আলোচনা, তরুণদের নৈতিক অনুপ্রেরণা দেওয়ার মতো কনটেন্ট তৈরি করে মানুষকে দ্বিনমুখী করারও অবকাশ রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে লোক সঠিক পথের দিকে ডাকে তার জন্য সে পথের অনুসারীদের প্রতিদানের সমান প্রতিদান রয়েছে। এতে তাদের প্রতিদান হতে সামান্য ঘাটতি হবে না।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৬৭৪)
অতএব একজন মুসলিম ইনফ্লুয়েন্সার যদি আন্তরিক নিয়তে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও দাওয়াহর উদ্দেশ্যে কাজ করেন, তবে তা নেক আমল হতে পারে।
আমাদের করণীয়
১. নিয়ত ঠিক করা : জনপ্রিয়তা নয়, আল্লাহর সন্তুষ্টি হবে চূড়ান্ত লক্ষ্য।
২. শরিয়তবিরোধী কনটেন্ট এড়িয়ে চলা : হাস্যরস বা বিনোদন করা যায়, তবে তা যেন শালীনতার বাইরে না যায়।
৩. জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সঙ্গে দাওয়াহ : মিথ্যা, গুজব বা অতিরঞ্জন নয়; বরং হতে হবে সত্যনিষ্ঠ উপস্থাপনায়।
৪. সময় ব্যবস্থাপনা : সোশ্যাল মিডিয়া যেন ইবাদত, পরিবার ও ইলম থেকে দূরে না সরায়।
ইন্টারনেট তারকা সংস্কৃতি আধুনিক দুনিয়ার এক অপ্রতিরোধ্য বাস্তবতা। ইসলাম এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করে না, বরং সঠিক পথে ব্যবহার করার দিকনির্দেশ দেয়। কোরআন-হাদিস আমাদের সতর্ক করেছে খ্যাতি-লোভের বিপদ সম্পর্কে, আবার কল্যাণের দাওয়াহর জন্য সুযোগও দিয়েছে। তাই আমাদের উচিত ইন্টারনেটের এ বিশাল প্ল্যাটফর্মকে ফিতনা ও বিভ্রান্তির মাধ্যম না বানিয়ে দাওয়াহ ও কল্যাণের ময়দান বানানো।
লেখক : শিক্ষার্থী, তাকমিল ফিল হাদিস, জামিয়া ইমদাদিয়া দারুল উলুম মুসলিম বাজার, মিরপুর, ঢাকা
বিডি প্রতিদিন/নাজিম