মরক্কোর উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত ফেজ শহরকে বলা হয় ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির এক অনন্য ভাণ্ডার। এটি মরক্কোর চতুর্থ বৃহত্তম শহর, তবে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধির দিক থেকে এটি নিঃসন্দেহে অনন্য। ফেজ শহরের প্রতিষ্ঠাতা হলেন ইদ্রিস আল-কুরাইশি, যিনি ইদ্রিস দ্বিতীয় নামেও পরিচিত। তিনি ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)-এর বংশধর।
দ্বিতীয় হিজরি শতাব্দীর শেষের দিকে তিনি মরক্কোতে আগমন করেন এবং ৮০৪ খ্রিস্টাব্দে ফেজ শহর প্রতিষ্ঠা করেন। এর মাধ্যমে তিনি এটিকে ইদ্রিস রাজ্যের রাজধানীরূপে গড়ে তোলেন। তিনি শুধু রাজনৈতিক রাজধানী হিসেবেই নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও সভ্যতার কেন্দ্র হিসেবেও ফেজকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। তাঁর নির্মিত অনন্য স্থাপত্য ও নিদর্শন শহরটির বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
এর ফলে ফেজ অল্প সময়ের মধ্যেই মরক্কোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নগরীতে পরিণত হয়। ৯২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এটি ছিল ইদ্রিস রাজ্যের রাজধানী। ফেজ শহরের ভৌগোলিক অবস্থানও খুবই বৈচিত্র্যময়। এটি মরক্কোর প্রায় কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত হওয়ায় অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য পথ এবং বহির্বিশ্বের বাণিজ্য রুটের মিলনস্থল হিসেবে বিশেষ কৌশলগত গুরুত্ব বহন করে।
শহরজুড়ে রয়েছে অসংখ্য ভূগর্ভস্থ জলের উৎস এবং উপত্যকার শৃঙ্খল, যা প্রাকৃতিকভাবে জলপ্রপাতের সম্প্রসারণ হিসেবে কাজ করে। চারপাশে পাহাড় ও ভৌগোলিক উচ্চতা ফেজকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। আবহাওয়ার দিক থেকে এটি মহাদেশীয় জলবায়ুর অন্তর্গত। গড় তাপমাত্রা প্রায় ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলেও গ্রীষ্মে তা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছায়। অন্যদিকে শীতে তাপমাত্রা নেমে আসে ৫-১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।
শহরটি গড় বৃষ্টিপাতও পায়, যা এর জলসম্পদকে সমৃদ্ধ করে। ফেজ শহরের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। এদের বেশির ভাগই মাগরেবি ও বারবার উপজাতির বংশধর, যারা প্রাচীনকাল থেকেই এই শহরে বসবাস করছে। আরব-ইসলামী সংস্কৃতি ও মাগরেবি ঐতিহ্যের সমন্বয় শহরটির সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে অসাধারণ রূপ দিয়েছে। এ কারণে ফেজকে আজও ইসলামী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মিলনকেন্দ্র বলা হয়। ফেজের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য ও নিদর্শনগুলো আজও ইসলামী সভ্যতার গৌরবগাথা বহন করে চলেছে।
আল-কারাউইয়িন মসজিদ : ৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত এই মসজিদ ইসলামী জ্ঞানচর্চার অন্যতম প্রাচীন কেন্দ্র। এর স্থাপত্য নকশা আলমোরাভি যুগের স্মারক বহন করে।
উত্তর টাওয়ার : ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে সাইদ রাজবংশের শাসনামলে নির্মিত এই সামরিক দুর্গটি পর্তুগিজ দুর্গের স্থাপত্যশৈলীর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।
আত্তারিন মাদ্রাসা : ১৩২৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তার অনন্য স্থাপত্যের জন্য বিখ্যাত। ফেজ শহর শুধু একটি নগরী নয়, বরং এটি ইসলামী ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রাচীন প্রাণকেন্দ্র। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাণিজ্য, জ্ঞানচর্চা ও সভ্যতার ধারক হিসেবে ফেজ মরক্কো এবং সমগ্র ইসলামী বিশ্বের ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।