ঢাকার গুলশানে হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় নিহত সেই অবিন্তা কবিরকে স্মরণ করল কলকাতা। এই উপলক্ষ্যে অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে অবিন্তা’র স্মৃতি চারণায় ‘এন ইন্টিমেট পোর্টেট অব অবিন্তা কবির’ নামাঙ্কিত একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
শুক্রবার সন্ধ্যায় কলকাতার ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন (আইসিসিআর)-এ এক অনুষ্ঠানে এই বইটির আনুষ্ঠানিক মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কলকাতাস্থ বাংলাদেশ ডেপুটি-হাইকমিশনার তৌফিক হাসান, বিশিষ্ট সাংবাদিক শুভজিৎ বাগচী, অবিন্তা কবিরের মা রুবা আহমেদ। বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের পর অবিন্তা কবিরের স্মরণে একটি ভিডিও ফুটেজও প্রদর্শন করা হয়।
মেয়ের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে এদিন আবেগঘন কান্নায় ভেঙে পড়েন রুবা। তিনি জানান ‘অবিন্তা আমার দুর্বলতা নয়, ও আমার শক্তি। তার কাছ থেকে আমি এই ফাউন্ডেশন গড়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছি। আসলে আমাদের দুই জনের মধ্যে শুধু মাত্র মা-মেয়ের সম্পর্ক ছিল না ও ছিল আমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু ও ছিল আমার আত্মা। আমরা যা কিছু করেছি, একসাথে করেছি, আমাদের চিন্তাভাবনাও এক ছিল। ও সবকিছু লিখে গেছে, আমায় বলে গেছে আমি যেন ওর কাজটা করি-আজ আমি সেই চেষ্টাই করছি’।
তিনি আরও জানান ‘অবিন্তা সবসময় নিজের দেশের জন্য কিছু করার স্বপ্ন দেখতো, তাই তার স্বপ্ন পূরণের জন্য আমরা এই ফাউন্ডেশনের সূচনা করি। মানুষ জানুক এই বিশ্বে সহিংসতার কোন স্থান নেই। ভালবাসার কোনও ভাষা বা দেশ হয় না’।
স্মৃতি সম্বলিত ‘এন ইন্টিমেট পোর্টেট অব অবিন্তা কবির’ বইটিতে তার পরিবারের কাছের মানুষ, বন্ধু এবং আত্মীয়রা লিখেছেন সেখানে তার ছোট বেলার কিছু ছবি, তার ব্যক্তিগত জার্নালের কিছু অংশ আছে যা পাঠককে তার সুন্দর ও সহানুভূতিশীল হৃদয়ের স্পর্শ দিয়ে যাবে, সেই সাথে জানা যাবে সেই সব দারুণ পরিকল্পনা যেটা হয়তো সে থাকলে আরও সঠিকভাবে বাস্তব রূপ পেত।
১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের এক শিক্ষিত পরিবারে জন্ম অবিন্তা কবিরের। ছোট থেকেই মেধাবী অবিন্তা তার শিক্ষাগত যোগ্যতার কারণে অক্সফোর্ডের এমোরি কলেজে পড়ার সুযোগ পান। তিনি তার পরিবারের সাথে ছুটি কাটাতে সেই ছোট বেলায় বিভিন্ন সময়ে কলকাতাতেও এসেছেন। এই শহরের সাথে তার মধুর সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল, তাই ভবিষ্যতেও নানা সময়ে এই শহরে ঘুরতে আসার পরিকল্পনা ছিল অবিন্তার। আসলে তিনি বাংলাকে সমসময় অন্য মর্যাদা দিয়ে এসেছেন। বাঙালি সংস্কৃতি, বাংলা ভাষা এমনকি বাঙালি হিসেবেও তিনি যথেষ্ট গর্ববোধ করতেন। শুধু শিক্ষার দিক থেকেই নয়, কোমল হৃদয়ের অবিন্তা পিছিয়ে পড়া মানুষদের প্রতি য়থেষ্ট সহানুভূতিশীল ছিলেন।
কিন্তু বাধ সাধল নিয়তি, ২০১৬ সালের ১ লা জুলাইয়ের সেই ভয়ঙ্কর রাত-যেদিন অবিন্তা তার বন্ধুদের সাথে ঢাকার হোলি আর্টিজান বেকারিতে গিয়েছিলেন এবং সন্ত্রাসবাদীদের নিষ্ঠুর আক্রমণের শিকার হন। মুহুর্তের মধ্যে কন্যা হারা শোকে পাথর হয়ে যায় তার পরিবার পরিজনেরা। তাদের কাছে এটা মেনে নেওয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে যে সন্ত্রাসবাদীদের হামলায় ছিন্নবিহ্ন হয়ে গেছে ফুটফুটে মেয়েটি।
মেয়ে হারানোর যন্ত্রণা বুকে নিয়েই অবিন্তার স্মৃতির উদ্যেশ্যে ২০১৭ সালের মার্চে ‘অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করেন মা রুবা আহমেদ। এর উদ্যেশ্য ছিল শিক্ষাবঞ্চিত শিশু, দরিদ্র পরিবার ও অ্যাসিড দগ্ধ নারীদের সহায়তার কাজ করা। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে হাত লাগিয়েছে এই ফাউন্ডেশন। আগামী ভবিষ্যতে কলকাতাতেও তাদের কাজ শুরু করার চিন্তাভাবনা রয়েছে এই ফাউন্ডেশনের।
অবিন্তার স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে ডেপুটি হাইকমিশনার তৌফিক হাসান বলেন ২০১৬ সালে গুলশানে যখন কিছু বিপদগামী তরুণ ধর্মের নামে অনেক বাংলাদেশি ও বিদেশি নাগরিকে নারকীয় ভাবে হত্যা করার পর পত্রিকায় পড়ে অবিন্তা নামটি প্রথমে আমার নজরে আসে, আজকে দেড় বছর পর অবিন্তা কবিরকে নতুন করে চিনলাম ‘এন ইন্টিমেট পোর্টেট অব অবিন্তা কবির’ বইটি পড়ে। আমেরিকায় পড়াশোনা করলেও তার হোস্টেলের রুমটিতে বাংলাদেশের পতাকা আঁকা ছিল, সে দেশের মানুষের জন্য ভাবতো, কিছু করতে চাইতো। অবিন্তার অর্থই হল সুন্দর আর সে প্রকৃত অর্থেই ছিল সহজ-সরল, চমৎকার বুদ্ধিমতি ও কৃত ছাত্রী। খেলাধুলাতেও ভাল ছিল। অবিন্তা সবসময় সুবিধাবঞ্চিত মানুষ, বয়স্ক মানুষদের জন্য কিছু করার কথা ভাবতো...।
অনুষ্ঠানের শেষে ছিল বাংলাদেশের বিশিষ্ট রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী শামা রহমানের সঙ্গীত পরিবেশনা।
বিডি-প্রতিদিন/ সালাহ উদ্দীন