২০ জুলাই, ২০২০ ১৬:৩৫

মেয়ের শাস্তি চায় আটক জেএমবি'র নারী জঙ্গি প্রজ্ঞার বাবা-মা

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

মেয়ের শাস্তি চায় আটক জেএমবি'র নারী জঙ্গি প্রজ্ঞার বাবা-মা

রাজধানী ঢাকায় গ্রেফতার হওয়া ভারতীয় নারী আয়েশা জান্নাত মোহনা ওরফে জান্নাতুল তাসনিম ওরফে প্রজ্ঞা দেবনাথ (২৫)-এর কঠোর শাস্তি চায় তার বাবা-মা। 

অনলাইনে জঙ্গি কার্যক্রম চালানোর অভিযোগে গত ১৭ জুলাই বাংলাদশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট’এর হাতে গ্রেফতার হয় পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার ধনেখালির বাসিন্দা আয়েশা। কেরানীগঞ্জের একটি মাদ্রাসার শিক্ষিকা আয়েশা শিক্ষকতার আড়ালে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারীদের অনলাইন জঙ্গি কার্যক্রমে দাওয়াত দিতেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। 

পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় গণমাধ্যমের দৌলতে ধনেখালির কেশবপুরের বাড়িতে বসে সেই খবর জানতে পারেন প্রজ্ঞার (ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আগে আয়েশার প্রকৃত নাম ছিল প্রজ্ঞা) বাবা-মা। চার বছর আগে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়া মেয়ের কথা স্মরণ করে প্রজ্ঞার মা গীতা দেবনাথ জানান, আমি চাই আইন অনুযায়ী ওকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হোক।
 
চুল পরিপাটি করে খোঁপা বাঁধা ঝরঝরে চেহারার তরুণী প্রজ্ঞা দেবনাথ প্রতিদিন সকালে সাইকেল চালিয়ে কলেজ রওনা দিতেন। পরিচিত কাউকে দেখলেই একগাল হাসি। চার বছর আগে ধনেখালির মানুষের কাছে প্রজ্ঞার এই ছবিটাই পরিচিত ছিল। কিন্তু সেই মেয়ের এই নতুন রূপ দেখে হতবাক তার প্রতিবেশীরাই। 

২০১৬ সালে দুর্গাপূজার আগে একদিন সকালে প্রজ্ঞা দেবনাথ ধনেখালির বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। সেসময় প্রজ্ঞা ছিলেন ধনেখালি কলেজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।  সেই দিনের কথা স্মরণ করে তার দিনমজুর বাবা প্রদীপ দেবনাথ জানান, আমরা আমাদের মেয়ের বিষয়টি জানতে পারি। আমরাতো প্রথমে বিশ্বাই করতে পারিনি। সে বরাবরই তার মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্থ থাকতো। কেউ হয়তো নিশ্চয়ই তাকে প্রভাবিত করেছে এবং এই কাজ করতে তাকে ভয় দেখিয়েছে। যদি সে কোন ভুল করে থাকে তবে তার শাস্তি পাওয়া উচিত। আমার মেয়ে যে কাজ করেছে তার জন্য তাকে দামতো দিতেই হবে। 

প্রজ্ঞার মা ৫০ বছর বয়সী গীতা দেবনাথ জানান, ২০১৬ সালে শেষবার ফোন করে মেয়ে জানায় সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। সেসময়ই আমি শেষবারের মতো তার সাথে কথা হয়। তার এই অপকর্মের জন্য তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াই উচিত।

গীতা দেবী আরও জানান, ২০১৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর মেয়ে ঘর ছাড়ে। রোজ দিনের মতোই সেদিন সকালেও সাইকেল নিয়ে বের হয়ে যায়। কয়েক ঘন্টা পর আমরা যখন তাকে ফোন করি তখন ওর মোবাইলটা সুইচড অফ বলে। আমরা তখন উন্মত্তের মতো সম্ভাব্য সব জায়গায় মেয়ের খোঁজ করি। কিন্তু কোথাও তাকে পাওয়া যায় নি। পরে পুলিশের কাছে গিয়ে অভিযোগ দায়ের করি।
 
ওই ঘটনার দুই দিন পর গীতা দেবীর কাছে একটি ফোন আসে। গীতা জানান, দুপুর নাগাদ আমার মেয়ে প্রজ্ঞাই ফোন করে। ও জানায় সে এখন বাংলাদশে আছে এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। প্রজ্ঞা আমার আশীর্বাদও চেয়েছিল এবং সেসময়ই আমার সাথে শেষবার কথা হয়েছিল। হঠাৎ করেই ফোনটা কেটে দেয়। তারপর থেকে আর ওই নম্বরে কোনও ফোন যায় নি।
 
সূত্রের খবর, ২০১৬ সাল থেকেই ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়েই বাংলাদেশ যাতায়াত করতো আয়েশা। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ সে কেরানীগঞ্জ থেকে একটি জন্ম নিবন্ধন সনদ সংগ্রহ করেন। ওই জন্ম নিবন্ধন সনদ দিয়ে পরবর্তীকালে একটি ভুয়া এনআইডি কার্ডও তৈরি করেন আয়েশা। 

আরও জানা যায়, প্রবাসী এক বাংলাদেশি নাগরিককে অনলাইনে বিয়ে করে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব নেওয়ার জন্য ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে আয়েশা। 
আদতে হিন্দু মেয়ে প্রজ্ঞার মুসলিম ধর্মান্তরিত হওয়াটা কোনভাবেই মেনে নিতে পারেননি তার মা গীতা দেবী। আর সেই কারণেই মেয়ের শর্ত মেনে তাকে বাড়ি ফিরিয়ে আনেননি মা। কারণ এতে সমাজ, প্রতিবেশিরা একঘরে করতো তাদের। তার ওপর ছিল প্রজ্ঞার ভাই অভিজিতের ভবিষ্যত। ফলে সেই থেকে বাড়ির সাথে কার্যত আর কোন যোগাযোগ ছিল না মেয়ের। 

বড় বোনের এভাবে চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারেননি প্রজ্ঞার ভাই অভিজিৎ। তিনি বলেন, আমরা চাইনি দিদি আর ফিরে না আসুক। দিদি ওই ভাবে বাড়ি ছাড়ার পর আমরা দিদিও প্রসঙ্গ এড়িয়ে চলতাম। এমনকি যারা জানেন না তাদের বলতাম দিদির বাইরে বিয়ে হয়েছে।
  
কিন্তু মেয়েকে নিয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত বা টেলিভিশনে প্রচারিত খবরে মেয়ের নামের আগে ‘সন্ত্রাসবাদী’ শব্দের ব্যবহার দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন গীতা দেবী। তিনি জানান, মেয়ে শরীর খারাপ হলে আমাকে ফোন করতো, সেই মেয়ে জঙ্গি হতে পারে আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না। তাছাড়া বাংলাদেশের পুলিশ বলছে অনলাইনে মেয়ের সাথে জঙ্গিদের যোগাসাজশ রয়েছে। কিন্তু আমার মেয়েরতো স্মার্ট ফোনই ছিল না। বাড়িতে কম্পিউটারও ছিল না। তাহলে কিভাবে যোগাযোগ হল?  

ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত তদন্তকারী সংস্থা সাবসিডিয়ারি ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (এসআইবি) সূত্রে খবর, ২০১৬ সালে ধনেখালির ঘর ছাড়ার পর তিনবছর ভারতে কাটান আয়েশা আর গ্রেফতার হওয়ার আগে শেষ একবছর তিনি বাংলাদেশে কাটান। 

এসআইবির এক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ পুলিশ গোটা বিষয়টি তদন্ত করছে। আমাদেরকে বলা হয়েছে যে বাংলাদেশে অবস্থান করার আগে ভারতে অবস্থানকালীন সময়ে আয়েশার সকল কার্যকলাপের নথি আমাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। আমাদের প্রধান লক্ষ্য হল ঘর ছাড়ার পর ভারতে তিন বছর থাকাকালীন সময়ে সে কোন কোন কার্যকলাপে যুক্ত ছিল তা খুঁজে বের করা।


বিডি-প্রতিদিন/সিফাত আব্দুল্লাহ

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর