সোমবার, ২৩ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

অপরাধ আখড়া কড়াইল বস্তি

অস্ত্র-মাদক কেনাবেচা, নারী-শিশু পাচার ছিনতাই, চুরি, ডাকাতির বাধাহীন সাম্রাজ্য

সাঈদুর রহমান রিমন

অপরাধ আখড়া কড়াইল বস্তি

রাজধানীর কড়াইল বস্তি। নানা অপরাধ সংঘটিত হওয়ার অভিযোগ এখানে —রোহেত রাজীব

রাজধানীতে অপরাধীদের সবচেয়ে নিরাপদ আস্তানা কড়াইল বস্তি এখন অস্ত্র-মাদক কেনাবেচা, নারী-শিশু পাচার, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি ও অসামাজিক কর্মকাণ্ডের বাধাহীন সাম্রাজ্য হয়ে উঠেছে। অস্ত্রবাজ সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য খ্যাত কড়াইল মাদকেরও খোলামেলা হাট-বাজার। অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানীর বিষফোঁড়া খ্যাত ‘কড়াইল বস্তি’ আবারও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে।

পুলিশের রুটিন অভিযান, মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান, যৌথ বাহিনীর চিরুনি অভিযান-কোনো কিছুতেই কড়াইল বস্তিকে মাদকমুক্ত করা যাচ্ছে না। বরং কড়াইল বস্তি থেকেই মাদকের পাইকারি চালান যাচ্ছে রাজধানীর সর্বত্র। এ বস্তিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী বাহিনী, ভাড়াটে খুনি চক্র। খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি মাদক ব্যবসাসহ সব ধরনের অপরাধে জড়িত এ বস্তির কয়েকটি চক্র। বছরের পর বছর ধরেই কড়াইল বস্তি সন্ত্রাসীদের অঘোষিত অভয়ারণ্যে পরিণত থাকলেও তাতে বাধ সাধতে পারেনি কেউ। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আশির দশক থেকেই সন্ত্রাসীদের আস্তানা এবং রাজধানীর অন্যতম মাদক স্পট হিসেবে পরিচিত কড়াইল বস্তি উচ্ছেদে সরকারের পক্ষ থেকে বহুবার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শত চেষ্টার পরও এখন পর্যন্ত বস্তিটি বহাল তবিয়তে আছে। এর দখল নিয়েও বহুবার প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। এখন আর আগের মতো সংঘাত-সংঘর্ষ না হলেও অপরাধ থেমে নেই। অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানীর গা-ঘেঁষে দিনে-দিনে বেড়ে ওঠা এই কড়াইল বস্তিতে কেউ জমির মালিক, কেউ বাড়ির মালিক কেউবা ভাড়াটিয়া, কেউ আবার হাওয়ার উপরেই বসবাস করছেন। কিন্তু কেউই প্রকৃত মালিক নন। আসল মালিক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিটিসিএল, গণপূর্ত এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। কিন্তু তারপরও এখানকার জমির মালিকের অভাব নেই, সেই জমি আবার কেনাবেচাও চলে। কখনো জমি, কখনো রেডিমেট বাড়ি কখনো জমি বাড়ি এক সঙ্গে বিক্রি হয়। একই জমির বারবার মালিকানা বদল হয়। হাত যত বদল হয়, ততই বাড়তে থাকে জমির দাম। অনেকে আবার আবাসন ব্যবসাও শুরু করেছেন সরকারি জমির ওপর। গড়ে ওঠা বিভিন্ন ক্লাব ও রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠনের প্রতিনিধিদের দিতে হয় এককালীন টাকা। এভাবেই টিকে আছে কড়াইল বস্তি। অভিযোগ রয়েছে, ছোট-বড় মিলিয়ে কমপক্ষে ২০টি গ্রুপের সদস্যরা কড়াইল বস্তি এবং পার্শ্ববর্তী লেক এলাকায় অবস্থান করে। বিভিন্ন স্থানে বসে বৈঠক। এসব বৈঠকেই ছিনতাই, ডাকাতি, গাড়ি চুরি এবং বাসাবাড়িতে চুরিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা হয়। বেশিরভাগই কড়াইল বস্তিতে আস্তানা গেড়েছে। বস্তিতে কিশোর সন্ত্রাসী বা বস্তির খুদে রাজা হিসেবে পরিচিত। অনেকের নামে হত্যা থেকে শুরু করে মাদক-ছিনতাই, চুরি, গাড়ি ভাঙচুর ও ডাকাতির একাধিক মামলা রয়েছে। মূলত কড়াইল বস্তি অপরাধের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, দিনের বেলায় কড়াইল বস্তির অবস্থা স্বাভাবিকই থাকে। কিন্তু রাতের বেলায় এই চিত্র বদলে যায়। সন্ধ্যার পর থেকেই বস্তিতে সন্ত্রাসীদের আনাগোনা বাড়ে। বাড্ডা, কচুক্ষেত, খিলক্ষেত, ভাটারা, বেরাইদ, মহাখালী এবং তেজগাঁও এলাকার সন্ত্রাসীরা এই বস্তিতে গিয়ে ঘাঁটি গাড়ে। এসব সন্ত্রাসী পুলিশ ও র‌্যাবের তালিকাভুক্ত। কিন্তু রহস্যজনক কারণে এরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।

খোলামেলা মাদক বাণিজ্য : এক সময়ের বস্তি মসজিদের এক মুয়াজ্জিন এখন কড়াইল সাম্রাজ্যের হর্তাকর্তা। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে তিনি ডাকসাইটে মাস্তান বনেছেন, জড়িয়ে পড়েছেন হেরোইন ফেনসিডিলসহ নানারকম মাদক ব্যবসায়। গোটা কড়াইল বস্তিজুড়েই তার একচ্ছত্র দাপট। তারই ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা হলেন ইয়াবা ডিলার। তাদের নেতৃত্বে কড়াইল বস্তি থেকেই গুলশান, বনানী, বাড্ডা, ভাটারাসহ আশপাশের বিভিন্ন থানা এলাকায় ইয়াবার সরবরাহ যায়। এদের আরেক সহযোগী নূরুল ইসলাম বস্তির ঝিলপাড়ে বসিয়েছে রমরমা জুয়ার আসর। রাত-দিন সেখানে লাখ লাখ টাকার জুয়া খেলা চলে। এ ছাড়াও বিচার শালিসের নামে অপকর্মের প্রতিবাদকারীদের শায়েস্তা করতে আওয়ামী লীগের অফিস বানিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে টর্চার সেল। নানা অপকর্মের অভিযোগে সম্প্রতি পুলিশের মহাপরিদর্শকের বরাবর লেখা ৪৫৩ বস্তিবাসীর সই করা স্মারকলিপিও কোনো কাজে আসেনি। কড়াইল বস্তিতে পাইকারি মাদক সরবরাহের আরেক মহারাজ হয়ে উঠেছে বনানী থানা পুলিশের ড্রাইভার ও কথিত সোর্স শহীদ। ২০০৫ সালে বিস্ফোরক ও অস্ত্রসহ বনানীর হিন্দুপাড়া বস্তি থেকে গ্রেফতার হওয়া শহীদ পুলিশের সোর্স পরিচয়ে সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছেন। এর আগে শহীদ গুলশান থানার সোর্স ও এসআই সোহেল রানার ড্রাইভার থাকাকালেই কড়াইল বস্তির একাংশ নিজের দখলে নেন। সেখানেই এখন গড়ে উঠেছে তার অপ্রতিরোধ্য মাদক সাম্রাজ্য। অনুসন্ধানে জানা যায়, বনানীর কড়াইলের বটতলার জলিলের মাদক স্পট, শাহ আলমের মাদক স্পট, টিঅ্যান্ডটি বাজারে পাগলির মাদক স্পট, আরশাদ নগর বস্তির জরিনার মাদক স্পট, এক নম্বর গোডাউন বস্তির ময়নার মার মাদক স্পট, আমতলীর জামাই মালেকের মাদক স্পট, ওয়্যারলেস গেটের ড্রাইভার কাশেমের মাদক স্পট, মহাখালী পশু হাসপাতাল সংলগ্ন নাটা ইউসুফের মাদক স্পট, সাততলা পুকুরপাড় মানিকের মাদক স্পটসহ ঢাকা উওর সিটি করপোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের  বেশ কিছু মাদক স্পট এবং মাদক ব্যবসায়ী থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করে শহীদ।

যারা চাঁদা দেয় না তাদের পুলিশে ধরিয়ে দিয়ে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, মহাখালীর কড়াইল বস্তির সন্ত্রাসীরা বেপরোয়াভাবে অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এমন কোনো অপরাধ নেই, যা সেখানে ঘটছে না। নিম্নআয়ের মানুষের পাশাপাশি বহু সন্ত্রাসীও স্থায়ীভাবেই আশ্রয় নিয়ে আছে। সেখানে প্রকাশ্যেই চলছে মাদক বেচাকেনা। এলাকার উঠতি বয়সী ছেলেরা ক্রমেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই এমনকি অপহরণ, খুন-ধর্ষণের মতো ঘটনাও ঘটছে অহরহ। অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী ও ছিনতাইকারীরা বিভিন্ন স্থান থেকে এসে বিভিন্ন সময় কড়াইল বস্তিতে জড়ো হয়। বস্তির কোনো ঘর অথবা লেকের পাশে বসেই চলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা। ঘন ঘন অভিযান হলে অপরাধীরা অন্যত্র পালিয়ে যায়। কিন্তু কিছু দিন পর আবারও সেইসব অপরাধী এখানে জড়ো হয়। তিনি আরও জানান, রাজনৈতিক আশীর্বাদ থাকায় প্রভাবশালীদের কারণে অনেক সময় পুলিশও এদের কাছে অসহায় হয়ে পড়ে। প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নানা উদ্যোগ নিয়েও তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর