শিরোনাম
মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

সমুদ্রসীমার ৯০ ভাগই নাগালের বাইরে

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

সমুদ্রসীমার ৯০ ভাগই নাগালের বাইরে

নিশীথ সূর্যের দেশ নরওয়ে তার গভীর সমুদ্রসীমায় মৎস্যসম্পদ আহরণের জন্য বাংলাদেশ থেকে ২০০০ (+) মেট্রিক টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন আন্তর্জাতিক মানের ট্রলার তৈরি করে নিচ্ছে। কিন্তু যে দেশটি এই জাহাজ তৈরি করে দিচ্ছে, তার নিজেরই সেই মানের জাহাজ নেই।

যেখানে উন্নত বিশ্বে মাছ ধরার কাজে ২ হাজার মেট্রিক টন বা তারও বেশি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ফিশিং ভেসেল ব্যবহার করা হয়, সেখানে বাংলাদেশের ফিশিং ভেসেলের সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা ৩০০ মেট্রিক টন। এত ছোট ভেসেল দিয়ে গভীর সমুদ্রের সম্পদ আহরণ সম্ভব নয়। বড় ভেসেল না থাকায় বাংলাদেশের অর্জিত সমুদ্রসীমার শতকরা ১০ ভাগ ব্যবহার করা যাচ্ছে। অর্থাৎ বাকি ৯০ ভাগ ব্যবহার করতে পারছে না বাংলাদেশ। খোদ শিল্প মন্ত্রণালয়ের তথ্য এটি। সম্প্রতি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো শিল্প মন্ত্রণালয়ের জাহাজ নির্মাণ খসড়া নীতিমালার ভূমিকায় বলা হয়েছে, ‘বর্তমানে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা ৬৬৪ কিমি। এর মধ্যে ব্যবহার হচ্ছে মাত্র ৬০ কিমি এলাকা। কারণ সাগরের বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা এবং কন্টিনেন্টাল সেলফ এলাকায় মাছ শিকার কিংবা অর্থনৈতিক ব্যবহারের সক্ষমতা এখনো তৈরি হয়নি।’

সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে দেশে নৌযান তৈরিতে ২০টি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ও ১০০টি স্থানীয় মানের শিপইয়ার্ড ও ডকইয়ার্ড রয়েছে। আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শিপইয়ার্ডগুলো বছরে ১০০টি জাহাজ তৈরি করতে পারে। দেশে বর্তমানে ১০ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন আন্তর্জাতিক মানের জাহাজও তৈরি হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো সমুদ্রে পড়ে আছে ৩০০ মেট্রিক টনের ভেসেল নিয়েই, যা দিয়ে ২০ থেকে সর্বোচ্চ ৬০ কিমি গভীর সমুদ্র পর্যন্ত মৎস্যসম্পদ আহরণ করা যায়। ফলে দেশের মূল্যবান মৎস্যসম্পদ নিয়ে যাচ্ছে বিদেশিরা। বিভিন্ন মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বঙ্গোপসাগর এলাকায় প্রতিবছর ৮০ কোটি টন মাছ ধরা পড়ছে। এর মধ্যে মাত্র দশমিক ৭ লাখ টন মাছ ধরে থাকেন বাংলাদেশের জেলেরা। অর্থাৎ বঙ্গোপসাগরের বিশাল মৎস্যসম্পদের ১ শতাংশও বাংলাদেশের জেলেরা ধরতে পারছেন না শুধু উন্নত ধরনের জাহাজ ও প্রযুক্তির অভাবে। আর এ সুযোগটি নিচ্ছেন বিদেশিরা। উপকূলীয় জেলেদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ, মিয়ানমার, ভারত ও থাইল্যান্ডের অনুমোদনহীন অত্যাধুনিক জাহাজগুলো প্রায়ই বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকে পড়ে। অনেক ছোট ছোট মাছধরার ট্রলারও জলসীমায় প্রবেশ করে জেলেদের মাছ ও মালপত্র লুটে নিয়ে যায়। এসব বিদেশি জাহাজ দেশীয় মাছধরার ট্রলারের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত। সে কারণে বিদেশি ট্রলারের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছেন দেশীয় জেলেরা। শুধু তা-ই নয়, উপকূলের নদ-নদীতে আট মাস (নভেম্বর থেকে জুন) জাটকা শিকারে নিষেধাজ্ঞা জারি থাকে। ওই সময় ইলিশ শিকার থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয় জেলেদের।ি কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞার সময়েও বাংলাদেশের সীমানায় ঢুকে ইলিশ ধরার মহোৎসব শুরু করে বিদেশি ফিশিং ট্রলারগুলো। এ কারণে অনেক সময় ভরা মৌসুমেও ইলিশের দেখা মেলে না উপকূলে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাগরে মূলত দুই ধরনের সম্পদ রয়েছে। এগুলো হলো প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদ। প্রাণিজ সম্পদের মধ্যে মৎস্য ও সামুদ্রিক নানা প্রাণী, লতাগুল্ম প্রভৃতি। এর বাইরে রয়েছে বিপুল পরিমাণে অপ্রাণিজ ও বিভিন্ন মূল্যবান খনিজ সম্পদ। অপ্রাণিজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে তেল, গ্যাস, চুনাপাথর এবং খনিজের মধ্যে আরও রয়েছে ১৭ ধরনের খনিজ বালু, যা সোনার চেয়েও দামি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-ইলমেনাইট, জিরকন, রুটাইল, ম্যাগনেটাইট, গ্যানেট মোনাজাইট, কায়ানাইট ও লিকোক্সিন। বঙ্গোপসাগরে এই আটটি খনিজ বালু বেশি পারিমাণে পাওয়া যায়। এগুলোর দামও অনেক বেশি। এ ছাড়া সাগরের তলদেশে ক্লেসার ডেপোজিট, ফসফরাস ডেপোজিট, এডাপোরাইট, পলিমেটালিক সালফাইড, ম্যাঙ্গানিজ নডিউল নামক খনিজ পদার্থ আকরিক অবস্থায় পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এদের পরিশোধনের মাধ্যমে লেড, জিঙ্ক, কপার, কোবাল্ট, মলিব ডেনামের মতো দুর্লভ ধাতুগুলো আহরণ করা সম্ভব হবে। এসব দুর্লভ ধাতু উড়োজাহাজ নির্মাণে, রাসায়নিক কারখানায় এবং বিভিন্ন কলকারখানায় উৎপাদন কাজে ব্যবহার করা যাবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূল্যবান এসব সম্পদ আহরণের জন্য বঙ্গোপসাগরে অর্জিত জলসীমার কোথায়, কী পরিমাণ সম্পদ আছে সে নিয়ে জরিপ ও গবেষণা প্রয়োজন। এমন আশঙ্কাও রয়েছে, বঙ্গোপসাগরের সম্পদ আহরণে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নিলে মৎস্যসম্পদের মতো সমুদ্রসীমার খনিজ সম্পদও লুট করে নিয়ে যাবে বিদেশিরা। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্স অ্যান্ড ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মো. শফিকুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘গভীর সমুদ্র থেকে সম্পদ আহরণের জন্য আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর যে ধরনের সক্ষমতা ও প্রযুক্তি থাকা প্রয়োজন সেটি নেই। সে কারণে এ বিষয়ে কোনো পূর্ণাঙ্গ জরিপ বা গবেষণা করা এখনো সম্ভব হচ্ছে না। আমরা নৌবাহিনীর বোট নিয়ে প্রাথমিকভাবে উপকূলের কাছাকাছি কিছু এলাকা নিয়ে কাজ করছি। গভীর সমুদ্রে এখনো পৌঁছাতে পারিনি।

সর্বশেষ খবর