সোমবার, ৬ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনা চিকিৎসায় দুই বাংলাদেশির সাফল্য যুক্তরাষ্ট্রে

লাবলু আনসার, নিউইয়র্ক

করোনা চিকিৎসায় দুই বাংলাদেশির সাফল্য যুক্তরাষ্ট্রে

ড. রায়হান সাদি

অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাওয়া লোকজন বাঁচতে খড়কুটোকেও বাঁচার অবলম্বন হিসেবে পেতে চান, ঠিক তেমনি করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের জন্য আশার সঞ্চার ঘটিয়ে মার্কিন মিডিয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি করেছেন বাংলাদেশি চিকিৎসক ড. মোহাম্মদ আলম। নিউইয়র্ক সিটি সংলগ্ন লং আইল্যান্ডে প্লেইনভিউ হাসপাতালের ‘সংক্রমিত রোগ বিশেষজ্ঞ ড. আলম কভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত ৮১ জন প্রবীণ রোগী চিকিৎসায় হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন  ব্যবহার করে আশাব্যঞ্জক ফল পেয়েছেন। ড. আলমের অধীনে থাকা লং আইল্যান্ডের ৩টি নার্সিং হোমের ৪৭ রোগীর চিকিৎসায় এই ওষুধ প্রয়োগ করেছিলেন। এর মধ্যে ৩৮ জনই  সুস্থ হয়েছেন। মারা গেছেন দুজন। অন্যরা চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ড. আলম নিউইয়র্কের ডেইলি পোস্টকে বলেছেন, ‘করোনায় আক্রান্তরা চিকিৎসা নিতে এসে একেবারেই অসহায় বোধ করেন। চিকিৎসক হিসেবে আমরাও যথাযথ ভূমিকা পালনে সক্ষম হচ্ছি বলে মনে হয়নি। এমন কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় আমি নিজে থেকে ভেবেছি যে, কিছু একটা করা দরকার। আমি বয়স্ক রোগীর আকুতিকে মনে করেছি যে, তিনি যদি আমার বাবা হতেন, তাহলে আমি কী করতাম? কী করা উচিত-এ সময়ে। আমি নিজে থেকেই তাদের জন্যে কিছু করার পদক্ষেপ নিয়েছি।’

গত ৪ এপ্রিল অপরাহ্ণে নিউইয়র্ক পোস্টে ‘লং আইল্যান্ড ডক্টর ট্রাইজ নিউ টুইস্ট অন হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ফর অ্যাল্ডার্লি কভিড-১৯ প্যাশেন্টস’ (Long Island doctor tries new twist on hydroxychloroquine for elderly COVID-19 patients) শিরোনামে প্রকাশিত এই সংবাদে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস করার পর যুক্তরাষ্ট্রে এসে চিকিৎসাবিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রিধারী ড. আলম উল্লেখ করেন যে, বহুল পরিচিত ম্যালেরিয়া প্রতিরোধক ‘হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন’ এবং জীবাণুনাশক ‘এজিথ্রোমাইসিন’কে একই সঙ্গে তিনি রোগীর ওপর প্রয়োগ করতে চাননি। তাহলে এই ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া চরম আকার ধারণ করতে পারে বয়স্ক রোগীর ক্ষেত্রে। কারণ, করোনায় আক্রান্ত রোগীর অধিকাংশই হৃদরোগী অথবা ডায়াবেটিসসহ জটিল রোগেও আক্রান্ত থাকতে পারেন। কিডনি রোগীও রয়েছেন কয়েকজন। ‘এ অবস্থায় এসব রোগীর জীবনকে আরও বিপন্ন করতে চাইনি’-উল্লেখ করেন ড. আলম। তিনি বলেন, আমরা আগেই এফডিএ (ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) থেকে জেনেছি যে, ‘এজিথ্রোমাইসিন’র প্রয়োগের ফলে হৃদযন্ত্রেও ক্রিয়া বন্ধ হয়ে রোগীর মৃত্যু হতে পারে।

নার্সিং সেন্টারের এসব রোগীর প্রায় সবাই হাইপারটেনশন, করোনা আর্টারি ডিজিজ, হৃদযন্ত্র অচল হয়ে পড়ার মতো জটিল রোগে আক্রান্ত। এসব কারণেই তারা নার্সিং হোমে অবস্থান করছেন সার্বক্ষণিক চিকিৎসকের নজরে থাকতে।

রোগীর বয়স এবং সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা সাপেক্ষে ‘এজিথ্রোমাইসিন’র পরিবর্তে বহু পুরনো একটি এন্টিবায়োটিক, যেটি হৃদযন্ত্র বিকল করার জন্য চিহ্নিত নয়, এমন একটি ওষুধ প্রয়োগ করেন ড. আলম। তিনি বলেন, ‘ডক্সিসাইক্লিন’ও ‘এজিথ্রোমাইসিন’র মতোই এন্টি-ইনফ্লেম্যাটেরি এবং এরও নিরাপত্তা নিয়ে কোনো সংশয়ের অবকাশ নেই। এ অবস্থায় আমি সিদ্ধান্ত নেই যে, কেন এটির প্রয়োগ করব না। ‘নার্সিং হোমের সীমিত সম্পদ নিয়েই আমরা মরণাপন্ন রোগীর জন্য কিছু করার পদক্ষেপ নেই’ বলে উল্লেখ করেন ড. আলম।

উল্লেখ্য, কভিড-১৯ প্রতিরোধে ডক্সিসাইক্লিন প্রয়োগের ক্ষেত্রে ড. আলমই একমাত্র চিকিৎসক নন। হেনরি ফোর্ড হেল্থ সিস্টেমও উপরোক্ত ৩টি ওষুধের সমন্বয় ঘটিয়ে রোগীর ওপর তা প্রয়োগ করেছে। অন্যদিকে, ড. আলমের রোগীর ৪৫ জনই ছিলেন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। তারা উচ্চমাত্রায় জ্বরের পাশাপাশি শ্বাস নিতে সক্ষম হচ্ছিলেন না, সঙ্গে ছিল কফ-কাশির যন্ত্রণা। নিজের ভিতরে জেগে ওঠা ওইসব ওষুধ প্রয়োগের আগে সংশ্লিষ্ট রোগীর স্বজনের কাছে লিখিত অনুমতি নেন ড. আলম। কারণ, ওই ধরনের ওষুধ প্রয়োগের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত ফেডারেল ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-এফডিএর কোনো ছাড়পত্র মেলেনি। ড. আলম বলেছেন, আমার রোগীর সিংহভাগই সেরে উঠেছেন। আমরা খুবই স্বস্তি পাচ্ছি। ৪৭ রোগীর ৩৮ জনই করোনাভাইরাস মুক্ত হয়েছেন। ৭ জনকে নিকটস্থ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। মারা গেছেন অপর দুজন। এই চিকিৎসা-ব্যবস্থার ওপর গভীর পর্যবেক্ষণের অবকাশ রয়েছে। আরও বেশি খতিয়ে দেখা জরুরি। তারপরই এর সুফল সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যেতে পারে। তবে দিন শেষে আমি স্বস্তিবোধ করছি যে, হাসপাতালের অনেক অনেক বেড (আইসিইউ) বাঁচিয়েছি। ভেন্টিলেটরের স্বল্পতার জটিলতা পরিহার করা গেছে।

১৯৬০ সাল থেকেই বহু পুরনো এই ‘ডক্সিসাইক্লিন’কে এভাবে ‘এজিথ্রোমাইসিন’র যথাযথ বিকল্প হিসেবে পরিণত করা সম্ভব হলো বলে মন্তব্য করেছেন একজন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। ‘যখন থেকে আমরা প্রবীণ রোগী, জটিল রোগে আক্রান্ত থাকায় এ সময়ে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন বলে মনে করছি, তাদের জন্য ‘এজিথ্রোমাইসিন’র পরিবর্তে এই ডক্সিসাইক্লিন নিয়ামক শক্তি হিসবে অভিভূত হলো। বড়কথা হচ্ছে ডক্সিসাইক্লিন কখনই হৃদরোগের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়’-উল্লেখ করেন বিশ্বখ্যাত ইয়েল স্কুল অব পাবলিক হেলথের ডিন ড. স্টেন এইচ ভারমুন্ড (Dr. Sten H. Vermund, the dean of the Yale School of Public Health.)। ড. ভারমুন্ড অবশ্য বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন যে, যেহেতু দুজন রোগীর মৃত্যু ঘটেছে, তাই পুরো প্রক্রিয়াটি নিয়ে বিশেষ পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে।

এ সময়ে সবচেয়ে বেশি সংকটে থাকা ভেন্টিলেটরের সমস্যা লাঘবে ভেন্টিলেটর তৈরির টেকনোলজি নিয়ে কুয়ান্টাইরা হেলথ সিস্টেমে (who is currently developing a ventilator technology at Quantaira Health) কর্মরত ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে প্রশিক্ষিত সংক্রমিত ডিজিজের বিশেষঞ্জ ড. রায়ান সাদি এ প্রসঙ্গে আরও যোগ করেছেন, ‘এই সমন্বয়ের ব্যপারে আমি খুবই আশাবাদী। তবে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী ক্লিনিক্যাল স্টাডির ভীষণ প্রয়োজন রয়েছে এই নবউদ্ভাবিত ওষুধ প্রয়োগের প্রচলনের আগে।’

এদিকে পাবনার সন্তান এবং ঢাকা মেডিকেল থেকে এমবিবিএস করার পর যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণকারী এবং দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন ফেডারেল স্বাস্থ্য বিভাগে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ড. সাদি (Dr. Ryan Saadi, a Yale-trained infectious disease epidemiologist who is currently developing a ventilator technology at Quantaira Health) বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, ‘এই ওষুধ প্রয়োগের পরিপ্রেক্ষিতে রোগীর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যতটা কমানো সম্ভব, সেটি বিবেচনায় রাখতে হবে। সেভাবেই ওষুধের ডোজ নির্ধারণ করা উচিত।’

সর্বশেষ খবর