ফরিদপুর আওয়ামী লীগে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে গ্রেফতার বরকত-রুবেল-লেভী-বিল্লাল গংদের নানা ‘অপকর্ম’ বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। এতদিন যারা ‘হাতুড়ি বাহিনী, ‘হেলমেট বাহিনী’-এর ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পাননি তারা এখন মুখ খুলছেন।
রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে দিনের পর দিন কয়েক নেতার অপ্রতিরোধ্য দুর্নীতি আর সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এক সময়ের শান্ত শহর ফরিদপুর। বিশেষ অভিযানে রাঘব-বোয়ালদের আটকের পর স্বস্তি নেমে এসেছে শহরবাসীর মনে। তবে অনেকেই মনে করছেন, যারা বরকত-রুবেল-লেভী গংদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, তারা এখনো রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। পৃষ্ঠপোষকদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবিতে সোচ্চার হচ্ছেন অনেকেই। ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব আলোচনা চলছে। নামপ্রকাশ না করার শর্তে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের প্রবীণ এক নেতা জানান, গ্রেফতার হওয়া শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি নাজমুল হাসান খন্দকার লেভী, সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বরকত, প্রেস ক্লাবের বহিষ্কৃত সভাপতি ইমতিয়াজ হাসান রুবেলসহ যারা দুর্নীতি ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনা করেছেন, তাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষককে গ্রেফতার করতে হবে। বরকত-রুবেল-লেভীদের কোনো ক্ষমতাই ছিল না শত শত কোটি টাকা আয় করার। তাদের পৃষ্ঠপোষক যিনি, তিনি তাদেরকে দিয়ে এসব করিয়েছেন। আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতাদের অভিযোগ, ফরিদপুর-৩ (সদর) আসনের এমপি খন্দকার মোশাররফ হোসেন এবং তার ভাই খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবরের হাত ধরে রাজনীতিতে আসা বরকত-রুবেল-বিল্লাল-লেভীরা ফরিদপুরের রাজনীতিসহ সব কাজের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন। ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে এখন পর্যন্ত দলের বিভিন্ন পর্যায়ের ১৬ জনকে আটক করেছে পুলিশ। অনেকেই রয়েছেন গ্রেফতারের তালিকায়। ফরিদপুরের পুলিশ সুপার আলিমুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেছেন, ফরিদপুরের মাটিতে আর কাউকে সন্ত্রাসী ও অপরাধমূলক কর্মকান্ড করতে দেওয়া হবে না। কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েই সাজ্জাদ হোসের বরকত ফরিদপুর শহর যুবলীগের সভাপতি বনে যান। ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের আশীর্বাদ পেয়ে ফরিদপুর জেলা বাস মালিক গ্রুপের নির্বাচিত কমিটিকে সরিয়ে দিয়ে তিনি সভাপতি হন। পরবর্তীতে সাজ্জাদ হোসেন বরকত শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। একই সঙ্গে তার ভাই ইমতিয়াজ হাসান রুবেল সাংবাদিকতার কোনো অভিজ্ঞতা না থাকলেও রাতারাতি প্রেস ক্লাবের সভাপতি হন। এসব করা হয় ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী এক নেতার নাম ব্যবহার করে এবং নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে। গ্রেফতার হওয়া শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি নাজমুল হাসান খন্দকার লেভী ও সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বরকতের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। লেভীর বিরুদ্ধে রাতের আঁধারে ফরিদপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদকের পদটি ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদককে সরিয়ে তিনি রাজনৈতিক ক্ষমতা দেখিয়ে সাধারণ সম্পাদক বনে যান। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে জায়গা দখল, টেন্ডারবাজি, শালিস বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। দুই হাজার কোটি টাকা মানি লন্ডারিং মামলায় তার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে সিআইডি। এ ছাড়া জেলা ক্রীড়া সংস্থায় ‘হাউজি খেলা’ বসিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। লেভী গ্রেফতার হওয়ার পর স্থানীয় নির্যাতিত মানুষ মুখ খুলতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই অনেকেই পুলিশ সুপারের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। এমনি একটি অভিযোগ দিয়েছেন সদর উপজেলার আলিয়াবাদ ইউনিয়নের বাসিন্দা, সেনাবাহিনীর (অব.) সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার জিয়ারত হোসেন। লেভী গংদের দ্বারা নির্যাতিত জিয়ারত হোসেন দীর্ঘ পাঁচ বছর পর আদালতে মামলা করেছেন। মামলায় তিনি অভিযোগ করেন, গজারিয়া বাজারে তার জমি ও একটি মার্কেটের ১০টি দোকান জোরপূর্বক দখল করে নেয় ভূমিদস্যুরা। প্রাণভয়ে তিনি সেই সময় কোনো কিছুই করতে পারেননি। সন্ত্রাসীদের ভয়ে তিনি ঢাকায় পালিয়ে যান। সম্প্রতি, অভিযানে কয়েকজন আটক হলে তিনি ফরিদপুরে ফিরে আসেন এবং মামলা করেন। মামলায় তিনি শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি নাজমুল হাসান খন্দকার লেভী, শাহজাহান বিশ্বাস, জিল্লুর রহমান টুটুল, মাইনুদ্দিন আহমেদ মানু, জাহাঙ্গীর খলিফা, ভগীরত সাহাকে আসামি করেন। এ বিষয়ে জিয়ারত হোসেন জানান, লেভী ও তার সহযোগীরা আমার জমি ও দোকান দখলে নিতে আমার বিরুদ্ধে দুটি ডাকাতির মামলা করে। আমি যাতে কোনো প্রতিবাদ না করতে পারি সে জন্য আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিলে আমি পালিয়ে ঢাকায় চলে যাই। শহর আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বরকতের বিরুদ্ধে পাহাড়সম অভিযোগ রয়েছে। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে সে ফরিদপুর ও আশপাশের জেলার ঠিকাদারকে জিম্মি করে তাদের লাইসেন্স নিয়ে কাজ করতেন। ফরিদপুর ও গোপালগঞ্জের ৭১ ও ৭৩ কোটি টাকার দুটি কাজ নেন ফরিদপুরের একজন প্রভাবশালী ঠিকাদারের লাইসেন্স নিয়ে। অভিযোগ রয়েছে, ওই ঠিকাদারকে বাধ্য করা হয় বরকতকে লাইসেন্স দিতে। এভাবে সে ফরিদপুর, খুলনা, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুর, গাজীপুর, গোপালগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের ঠিকাদারকে তার পৃষ্ঠপোষক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার নাম ব্যবহার করে লাইসেন্স নিয়ে নেন। কেউ এ বিষয়ে টুঁ শব্দটিও করতে সাহস পেতেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফরিদপুরের প্রভাবশালী এক ঠিকাদার জানান, আমার কাছ থেকে নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে লাইসেন্স নিয়েছে বরকত। সে সময়ে তাকে লাইসেন্স না দিলে আমার জীবন বাঁচানোই দায় হয়ে পড়ে। আমি বাধ্য হয়েই তাকে লাইসেন্স দিয়েছি। গ্রেফতারের পর সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদে বরকত তার নানা অপকর্মের বর্ণনা দিয়েছেন বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি শামসুল হক ভোলা মাস্টার বলেন, লুটপাটে বরকত-রুবেল-লেভী-বিল্লালদের ব্যবহার করেছেন স্থানীয় এমপি খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও তার ভাই খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবর। মোশাররফ হোসেন ও মোহতেশাম হোসেন বাবরের সম্পদের হিসাব নিলেই ‘থলের বেড়াল’ বেরিয়ে আসবে। ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ হোসেন বলেন, বরকত-রুবেল এক দিনে তৈরি হয়নি। তাদের আশ্রয় ও মদদ দাতাদের কারণেই তারা বেপোরোয়া হয়ে উঠেছিল। তাদের দাপটে আওয়ামী লীগের নিবেদিত কোনো নেতা-কর্মীই দলীয় কর্মকান্ডে অংশ নিতে পারেনি। তিনি বলেন, যারা এসব অন্যায় অপকর্ম করেছে তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে। জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বিপুল ঘোষ বলেন, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের বিভিন্ন ক্রয়ে দুর্নীতির যে অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তার সঙ্গে সরকারি গণমাধ্যমের একজন সাংবাদিকের নামও এসেছে। তাকেও আইনের আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি যারা গ্রেফতার হয়েছে তাদের স্বজনদের নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে। কারণ অনেকের নামে-বেনামে শত শত কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে।