শুক্রবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

বিপাকে পড়েছেন কর্মহারা নারীরা

নারী নেতৃত্বাধীন পরিবারের আয় কমেছে ৮০ শতাংশ

জিন্নাতুন নূর

বিপাকে পড়েছেন কর্মহারা নারীরা

করোনাকালে কাজ হারিয়ে বিপাকে পড়েছেন কর্মজীবী নারীরা। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, নারী-পুরুষ উভয়েই কাজ হারালেও পুুরুষের চাইতে নারী কর্মজীবীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। কারণ, পুরুষরা দ্রুত অন্যত্র কাজ খুঁজে নিলেও নারীর ক্ষেত্রে এ সুযোগ কম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাতিষ্ঠানিক খাতের চেয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত নারীরা কাজ হারিয়েছেন বেশি। মহামারীতে এসব খাতে কর্মরত নারীরাই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে পোশাক খাত এবং হোটেল-রেস্তোরাঁর শ্রমিক, প্রবাসী নারী শ্রমিক, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, কৃষি ও গৃহকর্মে জড়িত নারীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের এক গবেষণায় বলা হয়, করোনায় নারী নেতৃত্বাধীন পরিবারের আয় কমেছে ৮০ শতাংশ। মে মাসে পরিচালিত বেসরকারি সংস্থাটির গবেষণায় বলা হয়, মহামারীতে নারীপ্রধান পরিবারের ৫৭ শতাংশেরই কোনো উপার্জন নেই। এ ছাড়া বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন স্টেপস টুওয়ার্ডস ডেভেলপমেন্ট (স্টেপস) এবং জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যালায়েন্সের (গ্যাড অ্যালায়েন্স) তথ্যানুযায়ী লকডাউনের সময় থেকে ৮০ শতাংশ গ্রামীণ ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা তাদের চলমান ব্যবসা বা উদ্যোগ বন্ধ রাখতে বাধ্য হন। এমনকি করোনায় নারীদের চাকরি হারানোর ঝুঁকি বেড়েছে বলে সতর্ক করে দিয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা-আইএলও।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মহামারীতে পোশাক খাতের কর্মীরা সবচেয়ে বেশি ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন। বেসরকারি খাতে কর্মরত নারী কর্মকর্তাদের কেউ কেউ চাকরি হারিয়েছেন। কারও কারও বেতন কমানো হয়েছে। বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা পুঁজি হারিয়েছেন। এ অবস্থায় অনেক গৃহকর্মী ভিক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছেন। বিশেষ করে যেসব নারী সংসারে একমাত্র উপার্জনকারী তারা গোটা পরিবার নিয়ে বিপাকে পড়েছেন।

বিশেষজ্ঞরা জানান, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের মধ্যে কিছু কাজ নারীরা করেন যেগুলো বাজারনির্ভর। তারা বাজারে গিয়ে নিজেদের পণ্য বিক্রি করেন। কিন্তু মহামারীর ফলে বাজারনির্ভর সেই অর্থনীতি কমে গেছে। ফলে যেসব নারীর জীবিকা বাজারনির্ভর অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল ছিল তারা উপার্জন করতে পারছেন না। এ ছাড়া যেসব নারী ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তা ছিলেন তারা নিজেদের আয় দিয়ে ব্যবসা চালাতেন। কিন্তু আয় ও ব্যবসা চালানোর চক্রাকার ব্যবস্থাটি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় তাদের ব্যবসাও নষ্ট হয়ে গেছে। নষ্ট হয়েছে এ উদ্যোক্তাদের পুঁজিও। এদের সামলে ওঠার জন্য ক্রেডিট দরকার ছিল। কিন্তু সরকার এসএমই খাতের জন্য যে ক্রেডিট প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তা সত্যিকার অর্থে এসএমই খাতে আর পৌঁছাচ্ছে না। ব্যাংকগুলোও এ খাতে এখন অর্থ দিতে আগ্রহী নয়। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ মনে করছেন, নারী উদ্যোক্তাদের অর্থ দেওয়া হলে তা আর ফিরে পাওয়া যাবে না। অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনা সংক্রমণে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও কাজ হারাচ্ছেন। তারা যেসব ক্ষেত্রে কাজ করতেন বিশেষ করে পোশাক খাত, বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাংক থেকে তাদের ছাঁটাই করার খবর পাচ্ছি। এর ফলে কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের যে লিঙ্গসমতা অর্জিত হয়েছে সেখানে আমাদের পিছিয়ে পড়ারও আশঙ্কা রয়েছে।’ শ্রম মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের (ডিআইএফই) দেওয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনা পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পর ১৫ হাজার ৯৬৫টি কারখানা বন্ধ হওয়ায় কাজ হারিয়েছেন সাড়ে ১০ লাখ শ্রমিক। বন্ধ হওয়া কারখানাগুলোর মধ্যে তৈরি পোশাক কারখানা ১ হাজার ৯১৫টি। তৈরি পোশাক খাতে দেশে বর্তমানে ৪২ লাখ শ্রমিক কাজ করছেন। এর ৮০ শতাংশই  নারী। এ হিসেবে ধরে নেওয়া যেতেই পারে বন্ধ হয়ে যাওয়া পোশাক কারখানাগুলোর বেকার শ্রমিকের সিংহভাগই নারী। বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগও বলছে, করোনার কারণে সারা দেশের গার্মেন্ট কারখানা থেকে ৫০ হাজারের বেশি শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন, যার ৭০ শতাংশ নারী। কাজ হারিয়ে বিপাকে পড়েছেন দেশে ফিরে আসা প্রবাসী নারী শ্রমিকরাও। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ১৮ আগস্ট পর্যন্ত চাকরি হারিয়ে ২৩ হাজার ৫০২ জন শ্রমিক ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। এর মধ্যে ৯২৯ জন নারী। এ ছাড়া কাতার থেকে গত সাড়ে চার মাসে ৬ হাজার ৬৮ জন প্রবাসী কর্মী দেশে ফিরেছেন। তার মধ্যে ২৬৬ জন নারী। পোশাক খাতের পর বেশিসংখ্যক নারী গৃহকর্মী হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কেউ কেউ ছোট হোটেল কিংবা রেস্তোরাঁয়ও শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিল্স) হিসাব বলছে, দেশে গৃহশ্রমিক ২৫ লাখের বেশি। ৪ লাখের বেশি গৃহশ্রমিক শিশু, যার ৮৩ শতাংশ মেয়ে। করোনা সংকটের মধ্যে অনেক পরিবার নিজেদের সুরক্ষার কথা ভেবে ও টাকা বাঁচাতে এসব গৃহকর্মীকে কাজে আসতে বারণ করেছে। ফলে এ খাতে কর্মরত অনেক নারীও বেকার হয়ে পড়ছেন। মহামারীতে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছেন নতুন-পুরান নারী উদ্যোক্তারাও। দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মোট উদ্যোক্তা রয়েছেন ৭৮ লাখ, যার ৪০ শতাংশই নারী। কিন্তু করোনার ফলে এদের মধ্যে ৪০-৫০ শতাংশের ঝরে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। নারী উদ্যোক্তার একটা বড় অংশ কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু করোনার মধ্যে কৃষিপণ্য বিপণনে সীমাবদ্ধতার জন্য তাদের পক্ষে টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। নারী উদ্যোক্তাদের আরেকটি বড় খাত হলো বিউটি পারলারের ব্যবসা। এ খাতে সারা দেশে লাখ লাখ নারী কর্মরত ছিলেন। কিন্তু করোনায় ক্রেতা না থাকায় অনেক নারী উদ্যোক্তাই ক্ষতির মুখে এ ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। বড় যেসব পারলার এখনো ব্যবসা ধরে রেখেছে তারা কর্মী ছাঁটাই করে স্বল্প লোকবল দিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মাহবুবুল মোকাদ্দেম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনায় কর্ম হারিয়ে পুরুষের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কর্মজীবী নারী। আর প্রাতিষ্ঠানিক খাতের চেয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত নারীরাই কাজ হারিয়েছেন বেশি। যেসব নারীর জীবিকা বাজারনির্ভর অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল তারা আর উপার্জন করতে পারছেন না। করোনায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন নারী উদ্যোক্তারাও।’

সর্বশেষ খবর