শনিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গা স্থানান্তরে জটিলতা শুরু

ভাসানচরের সমস্যা

ফারুক তাহের, চট্টগ্রাম

রোহিঙ্গা স্থানান্তরে জটিলতা শুরু

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নানামুখী জটিলতায় ভেস্তে যাওয়ার মতোই জটিলতা তৈরি হয়েছে তাদের ভাসানচরে স্থানান্তরকে কেন্দ্র করে। প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছায় নিজ দেশ মিয়ানমারে যেতে না চাইলে রোহিঙ্গাদের জোর করে পাঠানো যাবে না বলে আন্তর্জাতিকমহল থেকে বারবার বলা হয়েছিল। তেমনি কক্সবাজারের ক্যাম্প থেকে হাতিয়ার ভাসানচরে স্থানান্তর প্রশ্নেও প্রায় একই কথা শোনা যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, জোর করে নয়, আন্তর্জাতিক মহলের সহযোগিতায় আলাপ-আলোচনা ও মোটিভেশনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পাঠাতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকেও এ কথা বলেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান। সবমিলে ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গা স্থানান্তর প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন নিয়ে দেশি ও আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করতে চররক্ষা বাঁধসহ ৩ হাজার ৯৫ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও গত এক বছরে কোনো রোহিঙ্গাকে স্থানান্তর করা সম্ভব হয়নি।

সম্প্রতি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেছেন, রোহিঙ্গাদের জন্য ভাসানচরে অত্যাধুনিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তাদেরকে সেই এলাকা সরেজমিন দেখানোও হয়েছে। তারা সন্তুষ্টও হয়েছেন। কিন্তু সেখান থেকে ফিরে আসার পর তারা সুর পাল্টিয়েছেন। আমরা তাদের জোর করে নয়, আন্তর্জাতিক মহলের সহযোগিতা নিয়ে আলাপ আলোচনা ও মোটিভেশনের মাধ্যমে পাঠাতে চাই। স্থানীয় প্রশাসন এবং শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমারের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের জন্য নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ভাসানচরে অত্যাধুনিক সুবিধা সংবলিত প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও সেখানে যেতে আগ্রহী না রোহিঙ্গারা। তারা বলছেন, ভাসানচরে আসার জন্য তারা বাংলাদেশে আসেননি। তার চেয়ে বরং নিজ দেশে ফিরে যেতে চান তারা। তাছাড়া চরটি দীর্ঘমেয়াদি বসবাসের জন্য উপযোগী কিনা তা নিয়ে ভাবা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মহলে। সব মিলিয়ে বিষয়গুলো নিয়ে এখনো পর্যবেক্ষণ করছেন রোহিঙ্গা মাঝি বা ক্যাম্প নেতারা। পররাষ্ট্র এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ভাসানচরকে রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ আবাস হিসেবে গড়ে তুলতে অন্তত ৫৫টি বিষয় সুরাহা করা উচিত বলে মত দিয়েছিল জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো। এ বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগে সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকা। তাদের নিরাপত্তা, খাবারের সরবরাহ, চিকিৎসাসেবাসহ জরুরি মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করা। নৌপথে ভাসানচরে যোগাযোগের ব্যবস্থা অন্যতম। জাতিসংঘের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সাহায্য সংস্থার জন্য দফতর নির্মাণের কথাও বলেছে উন্নয়ন সহযোগীরা। ভাসানচরকে নিরাপদ ও বাসোপযোগী করতে যে ৫৫টি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে, সরকার তার প্রায় সবকটি নিশ্চিত করেছে। তারপরও রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর নিয়ে জটিলতা তৈরি হচ্ছে। এ অবস্থায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে বলা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা ছাড়া ভাসানচরে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গার জন্য খাবার, স্বাস্থ্যসেবাসহ জরুরি মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করাটা কঠিন।

এদিকে ভাসানচরে পুনর্বাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের পর সরেজমিন দেখতে গত ৫ সেপ্টেম্বর দুই নারীসহ ৪০ জন রোহিঙ্গা প্রতিনিধি সেখানে যান। সে সময় তারা সেখানকার সার্বিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি দেখে জানিয়েছিলেন, তাদের জন্য সরকারের গড়ে তোলা অবকাঠামোগুলো মজবুত ও খুবই সুন্দর। পরিদর্শনে গিয়ে সব রোহিঙ্গা নেতার এ ব্যবস্থাপনা পছন্দ হয়েছে। তাছাড়া মানুষের বসবাসের জন্য যেসব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দরকার সেগুলোও ভাসানচরে রয়েছে। তারা বলেছিলেন, ক্যাম্পে ফিরে যাওয়ার পর তারা অন্যদের বিষয়গুলো সম্পর্কে জানাবেন এবং বোঝাবেন। কিন্তু তারা বোঝানোর আগেই ভাসানচরে রোহিঙ্গারা যেন স্থানান্তর না হয়, তা নিয়ে টেকনাফ ও উখিয়ার ক্যাম্পগুলোতে শুরু হয় মিথ্যা প্রপাগান্ডা। অতীতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে গঠিত যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের কর্মকান্ড নিয়েও ক্যাম্পগুলোতে মিথ্যা প্রপাগান্ডা ছড়ানো হয়েছিল। একইভাবে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হচ্ছে ভাসানচরে না যেতে। চরটিতে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য যে প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে, তা পরিদর্শনের জন্য যে ৪০ জন রোহিঙ্গা মাঝিকে (নেতা) নেওয়া হয়েছিল, তাদের অধিকাংশই ক্যাম্পে ফিরে গিয়ে নিজেদের মত পাল্টে ফেলেছেন বলে বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে। ভাসানচরের পক্ষে যেন কোনো কথা না বলা হয়, এ নিয়ে কোনো কোনো মাঝি হুমকির শিকারও হচ্ছেন বলে জানা যায়। সূত্র মতে, গত বছর বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে অন্তত এক লাখ রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর ভাসানচরে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কিন্তু জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর আপত্তির কারণে সে সময় রোহিঙ্গাদের আপাতত সেখানে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। মূলত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সহিংসতা ও বৈষম্য বন্ধে গত বছরের ২৩ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) রায়ের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পাঠিয়ে সরকার সমালোচনার মুখে পড়তে চায়নি বলে বিভিন্ন সূত্রে নিশ্চিত করেছে। সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের জন্য ভাসানচরের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে। জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস থেকে এই চরের ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা রক্ষা করতে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ তৈরি করেছে। এক লাখ রোহিঙ্গার জন্য সেখানে ১২০টি গুচ্ছ গ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের এক সভায় ভাসানচরের জন্য নেওয়া প্রকল্পের খরচ ৭৮৩ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৩ হাজার ৯৫ কোটি টাকা করা হয়েছে। বাড়তি টাকা ভাসানচররক্ষা বাঁধের উচ্চতা বাড়ানো, আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা, জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের জন্য ভবন ও জেটি নির্মাণে খরচ হয়। বাড়তি বরাদ্দের কারণে ভাসানচর রক্ষাকারী বাঁধের উচ্চতা ১০ ফুট থেকে বাড়িয়ে ১৯ ফুট করা হয়।

সর্বশেষ খবর