বৃহস্পতিবার, ২২ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা
দিনাজপুর শান্তিনিবাস

নতুন ঠিকানা খুঁজে পেয়েছেন তারা

মাহবুব মমতাজী, দিনাজপুর থেকে ফিরে

নতুন ঠিকানা খুঁজে পেয়েছেন তারা

জীবনের নতুন ঠিকানা খুঁজে পেয়েছেন সাইফুল কবির, আব্বাস, আইয়ুব, জিতেন, যোগেন, হেনা, শরীফারা। জীবনের শেষ সময় যাদের নাতি-নাতনিদের নিয়ে ঘরে বসে সুখে শান্তিতে থাকার কথা ছিল তাদের এখন ঠাঁই হয়েছে বৃদ্ধাশ্রম শান্তিনিবাসে। তবে ছেলেমেয়ে-নাতিনাতনিদের কথা মনে হলে চোখ বেয়ে অশ্রু নেমে আসে। কেউ এসেছেন অভাব-অনটনের সংসারে বোঝা হয়ে না থেকে, কেউ এসেছেন ছেলের বউয়ের নির্যাতন সইতে না পেরে, কেউ আবার ছেলেমেয়ের অবহেলায়। কারও ইচ্ছা নেই বাড়িতে ফিরে যাওয়ার। পরিবারের নির্যাতনের মুখে এখানে এসে তারা শান্তিতে আছেন। এমনটাই বলেছেন বৃদ্ধাশ্রমে থাকা প্রবীণরা। দিনাজপুর শহরের রাজবাড়ীতে একটি ভবনে চালু করা হয়েছে এ বৃদ্ধাশ্রম। ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ‘শান্তিনিবাস’ নামে এর যাত্রা হয়। তবে শুরুতে এখানে প্রবীণ ছিলেন ২০ জন। বর্তমানে আছেন সাতজন। বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নেওয়া বৃদ্ধবৃদ্ধাদের বয়স ৮০ থেকে ১০০ বছর পর্যন্ত। এদের নিজের সন্তানের মতো করে সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখেন সরকারি শিশু পরিবারের উপ-তত্ত্বাবধায়ক মাহমুদা নুসরাত জাহান। দিনাজপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক জামাল উদ্দিন আহমেদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও স্থানীয় এমপি ইকবালুর রহিমের উদ্যোগে এ প্রতিষ্ঠানটি চালু হয়। জেলার বিভিন্ন ব্যক্তি তাদের নাম-ঠিকানা গোপন রেখে এখানে সহযোগিতা করেন প্রায় ৪২ লাখ টাকা। এ টাকা ব্যাংকে আমানত রেখে মাসিক মুনাফা থেকে বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দাদের ভরণপোষণ চলে। এখানকার বাসিন্দাদের সেবা করতে পেরে খুবই খুশি সেবিকা ও বাবুর্চি সখিনা বেগম। প্রায় পাঁচ বছর ধরে তিনি এখানে কর্মরত। তিনি তার অনুভূতির কথা এভাবেই জানিয়েছেন। রাজবাড়ীর শান্তিনিবাসে এখন একা একা দিন কাটে একসময়ের প্রতাপশালী ঠিকাদার হুমায়ুন সাইফুল কবিরের। জীবনে তিনি অঢেল টাকা রোজগার করেছেন, ছেলে বিদেশে চাকরি আর মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করে বিয়েও দিয়েছেন। ঢাকায় আটটি ফ্ল্যাট, ছেলে বিদেশে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, মেয়ে কোটিপতি হয়েও জন্মদাতা বাবার খোঁজ নেননি দীর্ঘ ১১ বছর। তার ছেলে রাফিউল কবির কুয়েতে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে চাকরি করেন। মেয়ে শারমিন কবির মিমি বাবার দেখানো পথে ঠিকাদারি করে কোটিপতি হয়েছেন। কোটিপতি ছেলেমেয়ে থাকার পরও সাইফুল কবিরের শেষ ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম। এ বিষয়ে হুমায়ুন সাইফুল কবির বলেন, ‘আমি সড়ক ও জনপথ বিভাগে দীর্ঘদিন ঠিকাদারি করেছি। সৎ পথে প্রথম শ্রেণির ঠিকাদারি করে ছেলেমেয়েকে পড়ালেখা করিয়েছি। আমার ঢাকার মোহাম্মদপুরে সাত তলা একটি ভবনে আটটি ফ্ল্যাট ছিল। ছেলেকে চারটি এবং মেয়েকে চারটি ফ্ল্যাট লিখে দিই। বাকি অল্প একটু জমি মসজিদে দান করে দিয়েছি। ঠিকাদারির সুবাদে আমি দিনাজপুরে দীর্ঘ ২৪ বছর থেকেছি। ছেলেমেয়েকে মানুষ করেছি। কিন্তু সেই ছেলেমেয়েরাই আজ আমার খোঁজখবর নেয় না।’ মাহমুদা নুসরাত জাহান বলেন, ‘আমি আমার সাধ্যমতো তাদের দেখাশোনার চেষ্টা করি। তাদের যেন কোনো ধরনের কষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখি।’ তৎকালীন জেলা প্রশাসক জামাল উদ্দিন আহমেদ এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে একবার বলেছিলেন সরকারি শিশু পরিবারের পাশে বৃদ্ধাশ্রম করবেন। সে বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে আমি সেখানে পরিত্যক্ত একটি ভবন সংস্কার করে বৃদ্ধাশ্রম করার পরিকল্পনা নিই।’ স্থানীয় এমপি, জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম বলেন, ‘শান্তিনিবাসের বৃদ্ধ মা-বাবাদের যাতে কোনো ধরনের অসুবিধা না হয় সেজন্য সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখা হয়। তাঁরা সবাই আমার পরিবারের সদস্যের মতো।’

সর্বশেষ খবর