ভুট্টা খেতে যুবতীর লাশ। বয়স আনুমানিক ২০। গলায় ওড়না পেঁচানো। নাকের নিচে জমাট রক্ত। জিব একটু বের হওয়া। কাপড় ছেঁড়া। শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঁচড়ের দাগ। বড় কোনো ক্ষত না থাকলেও কিছু স্থান ফুলে লাল হয়ে আছে। পুলিশ হাজির। ধর্ষণের পর হতভাগ্য যুবতীটিকে শ্বাস রোধে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশের ধারণা এমনই। লাশ দেখতে আশপাশের ১০ গ্রামের মানুষ ভিড় করলেও কেউ পরিচয় জানাতে পারেনি। বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার ২০১০ সালের জুলাইয়ের ঘটনা এটি। ১৫ মাস পর আবারও তরুণীর লাশ। এবার একই গ্রামের ঈদগাহ মাঠে। এ তরুণীর বয়স ১৮। আগের যুবতীটিকে যেভাবে পাওয়া যায় একইভাবে পড়ে আছে এর দেহ। পুলিশ সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে। শরীরে আঁচড়ের চিহ্ন। তাকেও ধর্ষণের পর শ্বাস রোধে হত্যা করা হয়েছে। ময়নাতদন্তেও এসেছে এমন রিপোর্ট। অজ্ঞাতনামা হিসেবেই এ লাশ দাফন করা হয়। পরিচয় জানতে পারেনি পুলিশ।
আরও কয়েক মাস পর শিবগঞ্জ থানা পুলিশ আবারও যুবতীর লাশের সংবাদ পায়। এবার গ্রামের নাম নন্দীপুর। একটি মাঠে পড়ে ছিল ২২ বছরের যুবতীর লাশ। তাকেও ধর্ষণের পর গলা টিপে হত্যা করে ফেলে যায় দুর্বৃত্তরা।
তিনজনকে ধর্ষণের পর একই কায়দায় খুনের ঘটনার পর শিবগঞ্জ থানা পুলিশ নড়েচড়ে বসে। একজনের পরিচয়ও তারা বের করতে পারেনি। খুনিদের শনাক্ত পর্যন্ত করা যায়নি। পুলিশ এবার জোরালোভাবে তদন্ত শুরু করে। কিন্তু খুনের রহস্য বের করতে পারে না। এমন অবস্থার মধ্যেই শিবগঞ্জের একটি হলুদের খেতে আরও এক তরুণীর লাশ পড়ে থাকার খবর মেলে। পুলিশ নিজেই এবার আতঙ্কে। ব্যাপার কী? পুলিশ কর্মকর্তারা এসব খুনের কোনো সুরাহাই করতে পারছেন না। কিন্তু একে একে লাশ মিলছে। পুলিশ সদর দফতর থেকে বিষয়টি নিয়ে বগুড়ার পদস্থ কর্মকর্তাদের বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়। যেভাবেই হোক খুনিকে শনাক্তের পর গ্রেফতার করতেই হবে। এর বাইরে কোনো গল্প চলবে না। এমন কঠোর নির্দেশনার পর পুলিশ সর্বশক্তি নিয়োগ করে। কিন্তু আগের সব ঘটনার মতোই পুলিশ থাকে অন্ধকারে।শিবগঞ্জে আতঙ্ক তখন ঘরে ঘরে। সন্ধ্যার পর কিশোরী, তরুণী, ঘরের বউ- কেউ বাসা থেকে বের হওয়ার সাহস পায় না। কারা, কী উদ্দেশ্যে এসব ঘটাচ্ছে, কারও চোখে কেন পড়ছে না, পুলিশ কেন গ্রেফতার করতে পারছে না, লাশগুলোর পরিচয়ই বা কেন মিলছে না- এমন হাজারো প্রশ্ন মানুষের মনে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে। অনেকেই বলতে থাকে, এটা ভূত-প্রেতের কান্ড। ওঝা পীর ফকিরের আনাগোনা বেড়ে যায় শিবগঞ্জ গ্রামে। ঝাড়-ফুঁক চলতে থাকে। কিন্তু তারাও ব্যর্থ হন। আতঙ্ক যেন বাড়তেই থাকে।
গ্রামের পুরুষরা রাতে পালাক্রমে পাহারা বসান যদি কিছুর সন্ধান মেলে এ আশায়। কিন্তু দিনের পর দিন যায় কিছুই ধরা পড়ে না। সর্বশেষ খুনের ঠিক এক মাসের মধ্যে ২০১৩ সালের নভেম্বরে ধান খেতে আবারও লাশ। ছুটে যায় পুলিশ। ধান খেতে পড়ে আছে যুবতীর লাশ। এর বয়সও ২০। ধর্ষণের পর একই কায়দায় একেও হত্যা করা হয়। ২০১০ সালের জুলাই থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে এভাবেই একই কায়দায় ছয় যুবতী-তরুণীকে একই থানা এলাকায় ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। পুলিশ আর গোয়েন্দারা তদন্ত করেও কিছুই বের করতে পারেননি। লাশগুলোর পরিচয় অজ্ঞাতই থেকে যায়।
২০১৪ সালের ১৯ এপ্রিল শিবগঞ্জের নন্দীপুর মাঠের কলাবাগানে আবারও লাশের সন্ধান মেলে। এবার তরুণী নয়, তরুণের লাশ। তাকেও শ্বাস রোধে হত্যা করা হয়। পুলিশ লাশটি থানায় নিয়ে রাখে লাশ শনাক্তে কেউ আসে কি না সেজন্য। ঘণ্টাখানেক পর এক নারী থানায় আসেন। পুলিশকে বলেন, ‘এটা আমার ভাগনে সুজনের লাশ’। পুলিশ ভাবে, যাক, এই তরুণ তো আর অজ্ঞাত থাকল না। অন্তত এ খুনের রহস্য উদ্ঘাটন করা যাবে। এ চিন্তা করে ওই নারীর কাছে নানা বিষয় জানতে চায়। ২২ বছরের ওই নারী বলেন, ‘আমার নাম নিপা আক্তার। আমি ঢাকার একটি এনজিওতে কাজ করি। আমার স্বামীর নাম বাবু। পিচ্চি বাবু নামে পরিচিত। তার বাড়ি শিবগঞ্জেই। দুর্ঘটনায় স্বামী আহত হওয়ার সংবাদে ঢাকা থেকে ছুটে এসেছি। সঙ্গে এসেছে আমার ভাগনে সুজন। কিন্তু এসে দেখি সে আহত হয়নি। মিথ্যা কথা বলে আমাকে ডেকে নিয়ে এসেছে। আমার ভয় লাগছিল। ঢাকায় ফিরে যেতে চেয়েছি। কিন্তু আমার স্বামী বাবু যেতে না দিয়ে আমাকে রেখে দিয়েছে। ভাগনে সুজনকে বাসে তুলে দেওয়ার কথা বলে নিয়ে যায়। বাসায় স্বামী ফিরে আসে। রাতে আমাকে হত্যার চেষ্টা চালায়। আমি নানা কৌশলে নিজেকে রক্ষা করি। কিন্তু ভোরে দেখি সে নেই। পরে শুনলাম একটা লাশ নাকি পাওয়া গেছে। আমার বুকে কেমন যেন লাগে। দৌড়ে থানায় এসে দেখি আমার ভাগনের লাশ।’
পুলিশ এরপর নিপাকে নিয়ে ঢাকায় যায়। ২০১৪ সালের ২২ এপ্রিল ঢাকার দক্ষিণখানের একটি বাসা থেকে পিচ্চি বাবুকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তার সঙ্গে থাকা কথিত মা, গাজীপুরের জয়দেবপুর উপজেলার বুরুলিয়া গ্রামের দেলোয়ার হোসেনের স্ত্রী পারুলকেও গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারের পর পুলিশের কাছে কিশোর সুজনকে হত্যার দায় স্বীকার করেন পিচ্চি বাবু। বাবুর কথাবার্তায় পুলিশের কেমন যেন সন্দেহ হতে থাকে। শিবগঞ্জ থানা পুলিশ তাকে জেরা করতে থাকে। সন্দেহবশত পুলিশ তাকে তরুণী খুনের ঘটনা জিজ্ঞাস করে। একপর্যায়ে সে পুলিশকে বলে, ‘হ্যাঁ, ওই ছয় তরুণীকে আমি হত্যা করেছি। তার আগে বন্ধুবান্ধব মিলে ধর্ষণ করেছি।’ ওই যুবতী-তরুণীদের বাসাবাড়ি ঢাকায়। ঢাকা থেকে শিবগঞ্জে নিয়ে তিনি হত্যা করতেন বলে পুলিশকে জানিয়েছেন।
খুনের শিকার সেই ছয় যুবতী-তরুণীর লাশের ছবি দেখানো হয় বাবুকে। বাবু তাদের নাম-পরিচয় বলে দেন। এরা হলেন সোনিয়া আক্তার (২০), লাকী আকতার (১৮), তানিয়া (২২), লিপি (২০), শাপলা (২০)। তিনটি হত্যা মামলার তদন্ত ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়া হয়েছিল। ওই মামলাগুলোর তদন্ত আবারও শুরু হয়েছে।
সুজন নামে এক তরুণের খুনের তদন্তে বেরিয়ে আসে ছয় যুবতী-তরুণীর খুন-রহস্য। পুলিশ সন্ধান পায় চাঁদপুরের রসু খাঁর মতো আরেক সিরিয়াল কিলারের। শিবগঞ্জের নন্দীপুর গ্রামের ৩৫ বছর বয়সী মোমিন ওরফে বাবু ওরফে পিচ্চি বাবুর নেশাই হলো খুন। ধর্ষণ শেষে খুন। এরপর লাশগুলো ফেলে রাখতেন খেতের মধ্যে। ছয় যুবতী-তরুণীসহ সাত হত্যা আর অসংখ্য নারীকে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেন তিনি। পেশায় মাদক ব্যবসায়ী ও নানা অপকর্মের হোতা পিচ্চি বাবু সর্বশেষ হত্যাকান্ডের পর পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। একই সঙ্গে গ্রেফতার করা হয় এসব অপকর্মে তার সহযোগী চারজনকে। নানা কৌশলে মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তাদের নিয়ে অভিসারে যাওয়ার কথা বলে একের পর এক হত্যার এমন কাহিনি খোদ পুলিশকেও হতবাক করেছে।
গোয়েন্দারা জানতে পারেন, সিরিয়াল কিলার মোমিন ওরফে পিচ্চি বাবুর বাড়ি বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার মহব্বত নন্দীপুর গ্রামে। বাবার নাম সামসুল আলম। গ্রামের লোকজন তাকে মোমিন বলে জানলেও তিনি একেক জায়গায় একেক নামে পরিচিত। কখনো বাবু মন্ডল, কখনো পিচ্চি বাবু নামে পরিচিতি ছিল তার অপরাধজগতে। ১৫ বছর বয়সে গোবিন্দগঞ্জের রিক্তা নামে এক মেয়ের সঙ্গে বিয়ের পরই গ্রাম ছাড়েন তিনি। এরপর ঠাকুরগাঁওয়ে আরও একটি বিয়ে করেন। সেখানে তরমুজ ব্যবসা করার সময় ঢাকার ব্যবসায়ী ছামাদকে (৪০) খুন করে লাশ সেপটিক ট্যাংকে ফেলে দেন বাবু। ২০০৫ সালে এ ঘটনার পর খুনের নেশায় পেয়ে বসে তাকে।
পরে ঢাকায় গিয়ে মাদক ও নারী ব্যবসায় জড়িয়ে যান বাবু। পুলিশকে বলেন, ‘কোনো মেয়ের সঙ্গেই আমার এক সপ্তাহের বেশি সম্পর্ক রাখতে ভালো লাগে না। মন উঠে গেলেই হত্যা করতে মন চায়। ধর্ষণ আমার নেশা, একই ভাবে খুনও আমার নেশার মতোই।’