রবিবার, ২৩ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

বদলাচ্ছে বজ্রপাতের ধরন বাড়ছে প্রাণহানি

গত দেড় মাসে ১৬৭ জনের মৃত্যু

জিন্নাতুন নূর

দক্ষিণ এশিয়া পৃথিবীর বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাগুলোর একটি। এই অঞ্চলে বজ্রপাতের প্রবণতা অনেক বেশি বাংলাদেশে। আবহাওয়াবিদদের পর্যবেক্ষণ বলছে, দেশের উত্তরাঞ্চল এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বজ্রপাত বেশি ঘটে থাকে। আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে এখন বজ্রপাতেই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটছে এ দেশে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বজ্রপাতের ধরনেও পরিবর্তন এসেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তাদের মতে, বাংলাদেশ বজ্রপাতের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি এবং এ জন্য মানুষের প্রাণহানির সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। বছরে দেশে গড়ে তিন শর ওপর মানুষের মৃত্যু ঘটছে বজ্রপাতে। এরপরও বজ্রপাত নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। আবার সরকারের পক্ষ থেকেও বজ্রপাত মোকাবিলায় দৃশ্যমান উদ্যোগের যথেষ্ট ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। মূলত গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকায় বজ্রপাতের ঘটনা বৃদ্ধি পায়। গবেষকদের মতে, তাপমাত্রা এক ডিগ্রি বাড়লে বজ্রপাতের আশঙ্কা ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। আবার কালবৈশাখীর কারণে এপ্রিল থেকে জুন এ সময়ে বজ্রপাতের ঘটনাও বেশি ঘটে।  সংশ্লিষ্টরা জানান, বাতাসে সিসার পরিমাণ বৃদ্ধি, অতিরিক্ত তাপমাত্রা, মোবাইল ফোনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারজনিত রেডিয়েশন, গ্রামাঞ্চলে মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধি, তালগাছসহ উঁচু গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া এবং জলাভূমি ভরাটের কারণে বজ্রপাতের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। বড় বড় গাছ বজ্র প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে কিন্তু বসতবাড়ি নির্মাণ ও কৃষিকাজের জন্য গাছ কেটে ফেলায় বজ্রপাতে প্রাণহানি আগের চেয়ে বেশি। সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে গ্রামাঞ্চলে কৃষকরা ধান কাটায় ব্যস্ত থাকেন। এ সময় তাদের বজ্রপাতে দুর্ঘটনায় পড়তে দেখা যায়। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত বজ্রপাতে ২ হাজার ৭৭৪ জন মানুষ মারা যায়। চলতি বছরের এপ্রিল মাস থেকে বজ্রপাতে মৃত্যু নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মে মাসে এটি আরও বেশি। গত ১৮ মে এক দিনেই সারা দেশে ১৭ জন মানুষ বজ্রপাতে মৃত্যুবরণ করে। দুর্যোগ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন ডিজাস্টার ফোরামের এক প্রতিবেদন বলছে, গত দেড় মাসে বজ্রপাতে ১৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে বেশি মানুষ মারা গেছে সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও গাইবান্ধা জেলায়। আর বিভাগের মধ্যে বেশি মানুষ মারা  গেছে সিলেটে। বজ্রপাতে যারা মারা গেছে তাদের অধিকাংশই মাছ ধরছিল বা খোলা স্থানে কাজ করছিল। দেখা যায়, বজ্রপাতে একজন মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে আশপাশের অন্তত আরও ১০ জন মানুষ আহত হন। আর বজ্রপাতে আহতদের প্রায় সবাই গুরুতর আহত হয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে যান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণের ফলে উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশেও বিগত ৫ দশকের বেশি সময়ে ১.৫ ডিগ্রির মতো গড়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে শহরগুলোতেও। আবহাওয়াবিদরা জানান, একসময় দেশের একটি নির্দিষ্ট স্থানে বজ্রপাত হলেও এখন তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বজ্রপাতের সময়ও এসেছে পরিবর্তন। তাদের ধারণা, তাপমাত্রা পরিবর্তনের সঙ্গে বজ্রপাতের ঝুঁকি বৃদ্ধির যোগসূত্র আছে। তবে বজ্রপাত পূর্বাভাস যন্ত্রের আধুনিকায়ন ও নতুন প্রযুক্তির ব্যবস্থা করা হলে এই ঝুঁকি কমানো সম্ভব। 

আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে- অন্য যে কোনো দুর্যোগের চেয়ে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করলেও এর ঝুঁকি প্রশমনে দৃশ্যমান উদ্যোগ কম। বাংলাদেশে বজ্রপাতের পূর্বাভাস ও এলাকা শনাক্তকরণ যন্ত্র স্থাপন করা এখন সময়ের দাবি। কিন্তু সরকার বেশ কয়েকটি স্থানে বজ্রপাত পূর্বাভাস যন্ত্র বসালেও এর ফোরকাস্টিংয়ের ব্যবস্থা এখনো করতে পারেনি। এ জন্য আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। আবার বজ্রপাতের ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রাথমিক পর্যায়ে সারা দেশে ৫০ লাখ তালগাছের চারা রোপণের উদ্যোগ নিলেও এটিও খুব একটি কার্যকর নয় বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. এ কে এম সাইফুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গত কয়েক বছর ধরেই বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষিকাজ ও মৎস্যচাষে জড়িতরা  খোলা স্থানে কাজ করায় বজ্রপাতে এদের ঝুঁকিও বেশি। ক্ষয়ক্ষতি কমাতে এপ্রিলের শুরু থেকেই এ বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালানো দরকার। এ বিষয়গুলো পাঠ্যবইতে রাখতে হবে। হাওর এলাকাগুলোতে বজ্রপাত থেকে রক্ষার জন্য আশ্রয় কেন্দ্র তৈরি করা যেতে পারে। একই সঙ্গে বজ্রপাতে চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে সাধারণ মানুষ ততটা জানেন না। এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। আবার বজ্রপাতের শিকার ব্যক্তিদের সরকারি অর্থ সহায়তার পরিমাণ খুব কম। এটিও বৃদ্ধি করা উচিত।

সর্বশেষ খবর