মঙ্গলবার, ১৩ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠি

ঋণ পরিশোধে তিন প্রস্তাব ব্যবসায়ীদের

♦ করোনার ধাক্কায় ঋণের কিস্তি দিতে পারছে না অধিকাংশ শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ♦ ঋণ শ্রেণিকরণ সুবিধা ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর দাবি করেছে এফবিসিসিআই

রুহুল আমিন রাসেল

করোনা মহামারীতে বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম সচল রাখতে ঋণ বিরূপমানে শ্রেণিকরণ সুবিধা আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে এফবিসিসিআই। সংগঠনটি বাংলাদেশ ব্যাংকে দেওয়া পত্রে বলেছে- অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের গতিধারা স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সমুন্নত রাখতে হবে। এই লক্ষ্যে ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় বাড়ানো ও শর্ত সহজ করতে তিনটি প্রস্তাব বিবেচনা করতে বলেছে এফবিসিসিআই।

প্রস্তাব তিনটি হলো- এক. ক্ষুদ্র, মাঝারি ও অন্যান্য শিল্প এবং ব্যবসা- বাণিজ্যের বকেয়া অর্থের পরিমাণ ১০ কোটি টাকা বা তার কম হলে পরিশোধের ক্ষেত্রে প্রদেয় কিস্তিসমূহের কোনো প্রকার ডাউন পেমেন্ট না দিলেও মেয়াদোত্তীর্ণ হিসেবে শ্রেণিকরণ না করে ঋণ হিসাবটি পুনঃ তফসিল হিসেবে গণ্য হবে। দুই. ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে ১০ কোটি টাকার অধিক, কিন্তু ৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত প্রকল্প ঋণ সমৃদ্ধ শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রদেয় কিস্তিসমূহের ন্যূনতম ২ শতাংশ পরিশোধ করা হলে, ওই ঋণ বিরূপমানে শ্রেণিকরণ করা যাবে না। তিন. ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে ৫০০ কোটি টাকার অধিক প্রকল্প ঋণ সমৃদ্ধ শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রদেয় কিস্তিসমূহের ন্যূনতম ১ শতাংশ পরিশোধ করা হলে, ওই ঋণ বিরূপমানে শ্রেণিকরণ না করার অনুরোধ করেছে এফবিসিসিআই।

একই সঙ্গে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত ঋণ বিরূপমানে শ্রেণিকরণ সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রক্রিয়া চলমান রাখার দাবি জানিয়ে গত ৬ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরকে এ প্রস্তাবনা পত্র দিয়েছে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন-এফবিসিসিআই। সংগঠনটির সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন স্বাক্ষরিত পত্রে আরও বলা হয়, করোনা সংক্রমণ পুনরায় বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভয়াবহ ও অনিশ্চিত। এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় টিকে থাকার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক আরও সক্রিয় সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসবে, এমনটাই প্রত্যাশা দেশের আপামর ব্যবসায়ী মহলের। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ বা বিআরপিডি সার্কুলার-১৩/২০২১ অনুযায়ী প্রদেয় কিস্তিসমূহের ন্যূনতম ২০ শতাংশ ও ডিপার্টমেন্টস অব ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউট অ্যান্ড মার্কেটস বা ডিএফআইএম সার্কুলার-১৯/২০২১ অনুযায়ী প্রদেয় কিস্তিসমূহের ন্যূনতম ৫০ শতাংশ পরিশোধের শর্ত শিথিল করে ওই প্রস্তাব তিনটি বিবেচনা করা হোক।

এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া সুবিধাসমূহের মেয়াদ করোনা পরিস্থিতির উন্নতি এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রম স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বাড়ানো না হলে, অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অনিচ্ছাকৃত খেলাপি গ্রাহকে পরিণত হবে। এতে উৎপাদন ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম ভীষণভাবে ব্যাহত হবে। ফলে ব্যাংকিং খাতসহ পুরো অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে। এই শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমেও ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। ঋণগ্রহীতারা ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করার সক্ষমতা হারাচ্ছেন। অধিকাংশ ব্যবসায়ী শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সচল রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন এবং ঋণের কিস্তি সময়মতো পরিশোধ করতে পারছেন না। 

এ প্রসঙ্গে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি-ডিসিসিআই সভাপতি রিজওয়ান রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এক বছরে কেউ ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি। করোনাও যায়নি। করোনা যত দিন থাকবে, তত দিন এই ঋণ সুবিধা চাই। কমপক্ষে আগামী দুই বছর ঋণ পরিশোধের সুযোগ চাই।

এর আগে চলমান কভিড পরিস্থিতিতে ঋণ বিরূপমান শ্রেণিকরণ প্রক্রিয়া আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থগিত রাখার দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আসাদুল ইসলাম বরাবর গত ১৬ জুন দুটি পৃথক চিঠি দেয় এফবিসিসিআই। তখন একই দাবিতে পৃথক পত্র দেয় পোশাকশিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি-বিজিএমইএ ও বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি- বিকেএমইএসহ অন্যান্য বাণিজ্য সংগঠন। এই দাবিতে সাড়া দিয়ে গত ২৭ জুন ঋণ শ্রেণিকরণ সম্পর্কে ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ বা বিআরপিডি সার্কুলার-১৩/২০২১ জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ওই সার্কুলারে ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করলে গত জুনের খেলাপি হতেন- এমন ব্যবসায়ীদের ঋণ পরিশোধের মেয়াদ শর্তসাপেক্ষে আরও দুই মাস বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন সময়সীমা অনুযায়ী, জুনের মধ্যে পরিশোধ করার বাধ্যবাধকতা থাকা কিস্তিগুলোর ২০ শতাংশ অর্থ পরিশোধ করলেই ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ওই ঋণ খেলাপি করা যাবে না।

প্রসঙ্গত, ২০২০ সালজুড়ে ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত ছিলেন ব্যবসায়ীরা। ফলে কোনো অর্থ পরিশোধ না করেই ঋণগ্রহীতারা খেলাপি হওয়া থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে ২০২১ সালে এসে শর্তসাপেক্ষে ঋণ পরিশোধের সময়সীমা গত ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। গত ২৪ মার্চ জারি করা প্রজ্ঞাপনে অনাদায়ী সুদ আদায়সহ ঋণের কিস্তি পরিশোধের বিষয়ে রূপরেখা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কোনো গ্রাহকের ২০২০ সালের সুদ বকেয়া থাকলে চলতি মার্চ থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে ছয়টি ত্রৈমাসিক কিস্তির মাধ্যমে পরিশোধ করা যাবে। একই সঙ্গে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত যে সুদ আসে, তাও ত্রৈমাসিক কিস্তির মাধ্যমে পরিশোধ করার সুযোগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া তলবি ঋণ চলতি বছরের মার্চ থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮টি ত্রৈমাসিক কিস্তিতে পরিশোধ করার সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। যেসব ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বা চলমান ঋণের মেয়াদ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে এবং নতুন করে নবায়ন করা হয়নি, সেসব ঋণের শুধু সুদ পরিশোধ করলেই ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত খেলাপি হবে না বলে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আগের প্রজ্ঞাপনগুলোর মাধ্যমে প্রদত্ত সুবিধার আওতায় ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে জুন-২০২১ পর্যন্ত প্রদেয় কিস্তিগুলোর মোট পরিমাণের ন্যূনতম ২০ শতাংশ ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ৩১ আগস্ট ২০২১ তারিখের মধ্যে পরিশোধ করা হলে ওই সময়ে ঋণগুলো বিরূপমানে শ্রেণিকরণ করা যাবে না।

সর্বশেষ খবর