শিরোনাম
শুক্রবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

মৃত্যুর পর আনন্দ মিছিল

মির্জা মেহেদী তমাল

মৃত্যুর পর আনন্দ মিছিল

‘ওই তোর দিন শেষ।’ মোবাইল ফোনে যাকেই এমন হুমকি দিতেন তিনি, তার লাশ পড়ত। তার হুমকির পর তিন মাস বেঁচে ছিলেন পুরান ঢাকার একজন কাউন্সিলর আহাম্মদ হোসেন। অস্ত্রধারীরা তার লাশ ফেলেছে। সূত্রাপুর থানার এসআই গৌতম রায়কে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয় একই কায়দায়। পুলিশে চাকরি করেও প্রাণে রক্ষা পাননি গৌতম। তারও লাশ পড়ে। দুজনেরই হুমকিদাতা ছিলেন ভয়ঙ্কর অপরাধী শহীদ, ডাকাত শহীদ। দুর্ধর্ষ এই অপরাধীর অপরাধে কোনো রাখঢাক ছিল না। ঘোষণা দিয়েই খুন করেন তিনি। ডাকাত শহীদ যাকে ফোনে হুমকি দিতেন, তার লাশ পাওয়া যেত রাস্তায় কিংবা নর্দমায়। এক যুগের বেশি সময় ধরে পুরান ঢাকার ত্রাস ছিলেন এই শহীদ। কখনো নিজ হাতে মানুষ খুন করতেন, আবার কখনো তার অদৃশ্য নির্দেশে পড়েছে একের পর এক লাশ। বিদেশে পালিয়ে থেকেও দীর্ঘদিন নিয়ন্ত্রণ করেছেন অপরাধজগৎ। তার নির্দেশ মতো চাঁদা না দিলেই জারি হতো ডাকাত শহীদের ‘মৃত্যু পরোয়ানা’।

কিন্তু এক সময় তাকে থামতেই হয়েছিল। থামিয়েছিল র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। তাকে থামাতে গিয়ে র‌্যাব সদস্যদের জীবনবাজি রাখতে হয়েছিল। ডাকাত শহীদ বাহিনীর এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণে পাল্টা গুলি চালাতে হয়েছিল র‌্যাবকে। রীতিমতো একটি ছোটখাটো যুদ্ধের পর ডাকাত শহীদকে পরাস্ত করতে সমর্থ হয় র‌্যাব। আর ডাকাত শহীদের একটি মৃত্যুতেই রক্ষা পায় গোটা পুরান ঢাকা। অবসান হয় ডাকাত শহীদ ভয়ঙ্কর যুগের। যার কাছে রাজধানী ঢাকার একটি অংশ ছিল জিম্মি। যার মৃত্যুর পর আবালবৃদ্ধবনিতা, সব বয়স শ্রেণির মানুষ রাস্তায় নেমে আনন্দ মিছিল করেছে। লাশের ওপর থুথু ছিটিয়েছে। জুতা ছুড়েছে। ২০১২ সালের ঘটনা এটি। পুরো নাম শহীদুল ইসলাম শহীদ। ডাকাত শহীদ নামে তিনি পরিচিত ছিলেন। বাবা মৃত ইসমাইল হোসেন ওরফে আবদুর রহমান। গ্রাম-মাকডাল, থানা- শ্রীনগর, জেলা-মুন্সীগঞ্জ। ইসমাইল হোসেন পেশায় ছিলেন কৃষক। তাই সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে পারেননি। অবশ্য সেদিকে যেতে ছেলেটির আগ্রহও ছিল কম।

সদরঘাটের কুলি কিশোর বয়সেই একসময় হয়ে ওঠেন নৌ-ডাকাতদের রাজা। রাজধানীর পুরান ঢাকার এমন কেউ নেই, যিনি ডাকাত শহীদের নাম শোনেননি। আর এমন ব্যবসায়ী নেই, যিনি ডাকাত শহীদকে চাঁদা দেননি। তবে সামনাসামনি তাকে দেখা লোকের সংখ্যা হাতেগোনা। সেই ডাকাত শহীদ ২০১২ সালের জুনে পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে র‌্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। তার সঙ্গে নিহত হন সহযোগী কালু মিয়া ওরফে পাঞ্চি কালু। মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর অনেকেই তার লাশ দেখতে মর্গে ছুটে গেছেন। তবে এই ছুটে যাওয়া কোনো আফসোসের কারণে নয়। মানুষজন সেখানে গেছেন ঘৃণা প্রকাশ করতে। অনেকেই তার লাশের ওপর থুথু ছিটিয়েছেন। তবে ডাকাত শহীদ না থাকলেও রয়ে গেছে তার সহযোগীরা। তারাই এখন চাঁদাবাজি করছে পুরান ঢাকায়।

তদন্ত করতে গিয়ে ডাকাত শহীদ সম্পর্কে গোয়েন্দারা চাঞ্চল্যকর তথ্য পায়। ডাকাত শহীদ ২০-২২ বছর বয়সে ১৯৮৮ সালের দিকে সদরঘাটে কুলি হিসেবে কাজ শুরু করেন। ছিঁচকে চুরি করে অপরাধীর খাতায় নাম লেখান তিনি। ধীরে ধীরে শুরু করেন লঞ্চ ডাকাতি। কিন্তু তাকে ধরতে পারে না পুলিশ। তাই তখনই তার নাম হয় ডাকাত শহীদ। এরপর তিনি বিক্রমপুরে বাস শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৯০ সালে তিনি বাস শ্রমিক কমিটির যুগ্ম সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। সে সময় অস্ত্র, গুলি আদান-প্রদান এবং টিকাটুলী এলাকায় রাস্তা থেকে চাঁদা উঠানোর কাজ শুরু করেন। ওই বছরই একটি ডাকাতি মামলায় মুন্সীগঞ্জ জেলে তিন মাস কাটানোর পর বের হয়ে ১৯৯১ সালে কুয়েতে চলে যান। ১৯৯৪ সালে কুয়েত থেকে দেশে ফেরেন এবং নারায়ণগঞ্জ আদালত থেকে বেকসুর খালাস পান। তখন জুরাইনে আবুল গ্রুপের সঙ্গে অস্ত্রের মাধ্যমে টেন্ডারবাজি শুরু করেন। ১৯৯৮ সাল থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী লিয়াকতের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওয়ারীতে টেন্ডারবাজি শুরু করেন। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরতে হয়নি। অন্যদের বাদ দিয়ে নিজেই নেতৃত্ব নিয়ে শুরু করেন টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি। জুরাইন থেকেই তার একক নিয়ন্ত্রণের হাতেখড়ি। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, জুরাইনে তিনি অন্যের ভাড়াটিয়া হিসেবে জমি দখল করে দিতেন। সঙ্গে চাঁদাবাজি তো ছিলই। তখনই তিনি আলিম কমিশনারসহ দুজনকে খুন করেন। এর কিছুদিন পর তাঁতীবাজারে সোনা ব্যবসায়ী বাবা-ছেলেকে খুন করে আলোচনায় চলে আসেন। সবাই তাকে একনামে চিনতে শুরু করেন। নাম বললেই দিয়ে দেন চাহিদা মতো চাঁদার টাকা।

২০০২-০৩ সালের দিকে পূর্ণ উদ্যমে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ট্রাক-বাসস্ট্যান্ড দখল করার কাজ শুরু করেন ডাকাত শহীদ। ২০০৪ সালে ডিবির এসি আকরাম ৫টি অস্ত্রসহ তাকে আটক করেন। ঢাকা কারাগারে এক বছর থাকার পর বের হয়ে আবার চাঁদাবাজি শুরু করেন। র‌্যাব প্রতিষ্ঠার পর তিনি যশোর গিয়ে আত্মগোপন করেন। সেখানে তিনি ‘আরমান’ নাম ব্যবহার করে চলতে থাকেন। ২০০৫ সালে ভারত সীমান্তের পাশে বাসা ভাড়া করে অবস্থান করেন। তখন কালু প্রতি মাসে চাঁদার টাকা হুন্ডির মাধ্যমে শহীদের কাছে পাঠাত। এরপর তিনি কলকাতার নাগরিক হিসেবে বসতি স্থাপন করেন। এরপর বিভিন্ন সময়ে তিনি নদীয়া, কলকাতা, ওড়িশায় অবস্থান করেন। ২০১০ সালে তিনি নদীয়া থেকে নেপালে চলে যান। পরে বাংলাদেশের শিল্পপতি হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিয়ে সেখানকার একটি মেয়েকে বিয়ে করেন। ডাকাত শহীদ কতগুলো খুন করেছেন তার কোনো পরিসংখ্যান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছেও নেই। শুধু যেসব ঘটনায় মামলা হয়েছে তারই হিসাব দিতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের হিসাবে ৮টি খুনের মামলাসহ দেড় ডজন মামলা ছিল ডাকাত শহীদের বিরুদ্ধে। কিন্তু বাস্তবে তার খুনের সংখ্যা অর্ধশতাধিক। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, ৩৮টি মামলার হিসাব তাদের কাছেই ছিল। আর জিডির সংখ্যা সহস্রাধিক।

পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, ডাকাত শহীদের হাতে যারা খুন হন তাদের মধ্যে আছেন ওয়ার্ড কমিশনার আলিমসহ দুজন, তাঁতীবাজারের সোনা ব্যবসায়ী প্রেমকৃষ্ণ ও তার ছেলে অ্যাডভোকেট হাবিবুর রহমান মন্ডল, ওয়ার্ড কমিশনার বিনয় কৃষ্ণ, ছাত্রদল নেতা ছগির আহমেদ, যুবলীগ নেতা শিমুল এবং কমিশনার আহাম্মদ হোসেন, কেরানীগঞ্জের ববি, ছাত্রদল নেতা লাসানী। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ ও পরে গেন্ডারিয়ায় একই দিনে ছয়জনকে হত্যা করেছিলেন এই ডাকাত শহীদ। ডাকাত শহীদের নামে চাঁদা উঠত কোটি কোটি টাকা। নিচে ৫ লাখ আর উপরে ৫০ লাখ। পুরান ঢাকাজুড়ে ছড়িয়ে ছিল তার শতাধিক ক্যাডার। একেক এলাকা একেকজন নিয়ন্ত্রণ করত। চাঁদা তোলার পর বড় অংশই চলে যেত বিদেশে ডাকাত শহীদের কাছে। আত্মগোপনে থেকেও সহযোগীদের দিয়ে টেলিফোনের মাধ্যমে দেশে নিয়মিত চাঁদাবাজি চালিয়ে যান।

অবশেষে ২০১২ সালের জুলাইয়ে অবসান ঘটে শহীদ যুগের। র‌্যাব জানতে পারে পয়লা জুলাই ডাকাত শহীদ তার সহযোগীদের নিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে আসে। ৪ জুলাই রাত পৌনে ১২টার দিকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে লক্ষ্মীবাজার এলাকায় সন্ত্রাসীদের অবস্থান জানতে পেরে অভিযান চালায় র‌্যাবের চারটি টিম। এ সময় হঠাৎ সন্ত্রাসীদের মুখোমুখি হয় র‌্যাব। র‌্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে সন্ত্রাসীরা গুলি ছোড়ে। এ সময় র‌্যাবও পাল্টা গুলি চালায়। প্রায় ১৫ মিনিট গোলাগুলির পর ঘটনাস্থল থেকে ডাকাত শহীদসহ তার সহযোগীর লাশ উদ্ধার করা হয়।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর