বুধবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

জেল পালানো মকিম গাজী

মির্জা মেহেদী তমাল

জেল পালানো মকিম গাজী

নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকের ঘটনা। ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগারে বেজে উঠল পাগলা ঘণ্টা। নানা কারণেই কারাগারের অভ্যন্তরে পাগলা ঘণ্টা বাজতে পারে। এসব কারণের মধ্যে একটি অন্যতম হলো জেল থেকে বন্দী পালিয়ে গেলে। এমনই এক জেলে পালানোর ঘটনায় পাগলা ঘণ্টা বাজতে থাকে কারাগারের ভিতর। কারারক্ষী থেকে শুরু করে পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের তৎপরতা শুরু হয়ে যায়। একের পর এক পুলিশের ভ্যান এসে কারাগারের ফটকের সামনে হাজির। পদস্থ কর্মকর্তারাও এ নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। যিনি পালিয়েছেন, তিনি আর কেউ নন। তৎকালীন সময়ের দুর্ধর্ষ মকিম গাজী। আশির ও নব্বইয়ের দশকে দেশের ডাকাত জগতের এক সম্রাটের নাম। পটুয়াখালীর মাটিভাঙা গ্রামে জন্ম নেওয়া এ ডাকাতের নাম শুনলে সাধারণ মানুষ আঁতকে উঠত। এ ডাকাত জেল থেকে পালিয়েছেন। পুলিশ প্রশাসনকে ভাবিয়ে তুলেছেন এ মকিম ডাকাত।

ডাকাত মকিম গাজীর জেল পালানোর সংবাদ শিরোনাম হয়ে ওঠে পত্রিকার পাতায়। ঢাকার তৎকালীন সবগুলো থানা, এসবি, ডিবিসহ সব গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যই হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকেন মকিম গাজীকে। তৎকালীন ইন্সপেক্টর আকরাম হোসাইন ডিবিতে। তার ওপর দায়িত্ব পড়ল মকিমকে ধরতে হবে। আকরাম হোসাইন একাধিকবার গ্রেফতার করেছেন মকিম গাজীকে। তাই মকিম গাজীর অবস্থান সম্পর্কে তার খোঁজখবর নেওয়া অনেকটা সহজ ছিল। দুপুরেই সংবাদ এলো মকিম গাজী তৎকালীন ডেমরা থানার কোনাপাড়া এলাকার একটি ঝুপড়ি ঘরে অবস্থান করছেন। সঙ্গে সঙ্গে সিভিল পোশাকে ছদ্মবেশে ওই বাড়ির চারপাশে অবস্থান নেয় গোয়েন্দা পুলিশের দলটি। ধীরে ধীরে মকিম গাজীর অবস্থান করা ঘরটির কাছে পৌঁছায় পুলিশের দল। কিন্তু ভাগ্য খারাপ। মকিম গাজী পুলিশের অবস্থান জেনে যান। বাড়ির পেছনের ঘরের বেড়া কেটে পালিয়ে যান মকিম। এ সময় একজন পুলিশ অফিসার মকিম গাজীকে ঝাপটে ধরে চেংদোলা করে মাথার ওপরে তুলে ধরে চিৎকার করে বলতে থাকেন- স্যার পেয়ে গেছি, স্যার পেয়ে গেছি। জেল পলাতক মকিম গাজীকে গ্রেফতার পুলিশের মর্যাদার বিষয় হয়ে দেখা দিয়েছিল। পালানোর ২৪ ঘণ্টা না যেতেই মকিম গাজীকে আটকে ডিবি পুলিশের সদস্যরা আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠেন। ডিবির প্রায় সবকয়টি টিমের সদস্যই অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন। মকিম গাজীকে কঠোর পাহারায় মতিঝিল থানা হাজতে রাখা হয়। এ সময় রাতে তাকে ডাল-রুটি দেওয়া হলে মকিম গাজী পুলিশের উদ্দেশে বলেন, মকিম গাজী ডাল-রুটি খায় না, মোড়গ-পোলাও খায়। পরদিন কয়েকটি সংবাদপত্রে মকিম গাজির এ ডায়ালগ ছাপা হয়েছিল। এর আগে আরও একবার জেল থেকে পালিয়ে যান মকিম গাজী। সেবার আদালতপাড়ায় বোমাবাজি করে তার সহযোগীরা তাকে ছিনিয়ে নিয়ে পালান। সেবারও পুলিশের ঘুম হারাম করে দেন মকিম গাজী। ঢাকার সবকটি থানার পুলিশ তখন চষে বেড়াচ্ছে মকিমকে গ্রেফতার করতে।  ১৯৮৮ সালের দিকে ডাকাত মকিম গাজী মগবাজারের বটতলী এলাকার একটি বাড়িতে অবস্থান করছেন- এমন খবর পেয়ে দলবল নিয়ে ওই বাড়ির অবস্থান দেখতে যান পরিদর্শক আকরাম। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসছে। কিন্তু কিছুতেই মকিম গাজীর অবস্থান করা বাড়িটি শনাক্ত করতে পারছিলেন না। এ সময় একটি বাড়ি থেকে বের হওয়া একজন পথচারীর কাছে আকরাম জানতে চান, এখানে দুই-তিন দিন হয় একজন নতুন ভাড়াটিয়া উঠেছেন। এটি কোন বাসা বলতে পারেন? ভদ্রলোক আঙুলের ইশারায় দূরে একটি বাড়ি দেখিয়ে দ্রুত হাঁটতে থাকেন। এ সময় গলি থেকে দৌড়ে এসে স্থানীয় সোর্স আকরামকে বলেন, স্যার আপনার সঙ্গে এইমাত্র কথা বলা লোকটিই মকিম গাজী। তখনই পুরো এলাকায় ছড়িয়ে থাকা গোয়েন্দা দলের সদস্যরা দৌড়ে তাকে ঝাপটে ধরে ফেলেন।

পটুয়াখালীর মাটিভাঙা গ্রামের হামিদ গাজীর ছেলে মকিম গাজী কিশোর বয়স থেকে নৌ-ডাকাতি শুরু করেন। এরপর মকিম গাজী নিজেই ডাকাত দল গঠন করে ঢাকাসহ সারা দেশেই বাসাবাড়িতে ডাকাতি করে বেড়াতেন। তার দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন লাল গাজী, মোস্তফা কামাল, কাঞ্চন গাজী প্রমুখ।

ঢাকার বিভিন্ন থানায় ১৩টি মামলায় তার ১১০ বছরের জেল হয়েছিল। ঢাকায় মকিম গাজীর টার্গেট ছিল পুরান ঢাকার লালবাগ, সূত্রাপুর, কোতোয়ালি, অভিজাত এলাকা ধানমন্ডি, মতিঝিল রমনা এলাকা। মকিম গাজী প্রায় ৩০ বছর ধরে কারাগারে বন্দী আছেন। এর মধ্যে অনেক মামলায় আদালতে রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী উপস্থাপন করতে না পারার ব্যর্থতায় খালাশ পেয়েছেন। কারাগারে এখন তার বয়স ৭০-এর বেশি। বিভিন্ন সময়ে কারাবিধি অনুযায়ী ২০ বছর জেল খাটার পর বন্দীর আচরণ ভালো থাকায় মুক্তি দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তার নাম পাঠানো হলেও জেল পালানোর কারণে তার মতো দাগি অপরাধীকে মুক্তির বিবেচনায় আনা হয়নি। তিনি আছেন এখন কাশিমপুর কারাগারে। তাকে সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে রাখা হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর