শুক্রবার, ১৪ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

বিধিনিষেধে বদলায়নি কিছুই

সংক্রমণের সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুও, যত আসন তত যাত্রী নিয়ে চলবে যানবাহন

শামীম আহমেদ

বিধিনিষেধে বদলায়নি কিছুই

স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই, গাদাগাদি করে বাসে উঠছেন যাত্রী। গতকাল যাত্রাবাড়ী থেকে তোলা ছবি -জয়ীতা রায়

করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে ১১ দফা বিধিনিষেধ দিয়ে সরকারের নির্দেশনা গতকাল থেকে কার্যকর হলেও এর প্রভাব পড়েনি কোথাও। রাজধানীর গণপরিবহন থেকে হাট-বাজার, অলিগলি, রেস্তোরাঁ, চায়ের দোকান, সেলুন সবই চলতে দেখা গেছে আগের নিয়মে। কোথাও নেই মাস্কের ব্যবহার। তবে জরিমানা এড়াতে মূল সড়কে পথচারীদের মধ্যে মাস্কের ব্যবহার কিছুটা বাড়তে দেখা গেছে। এ ছাড়া খুলনা ও বরিশাল মহানগরসহ দেশের অধিকাংশ এলাকায় বিধিনিষেধের কোনো প্রভাব পড়েনি বলে জানিয়েছেন আমাদের সংবাদকর্মীরা।

সরকারের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, অফিস-আদালত, দোকান, শপিং মল, বাজার, হোটেল-রেস্তোরাঁসহ সব জনসমাগমস্থলে মাস্ক না পরলে শাস্তির মুখে পড়তে হবে। রেস্তোরাঁয় খাদ্য গ্রহণে দেখাতে হবে টিকা সনদ। নির্দেশনা বাস্তবায়নে পরিচালনা করা হবে মোবাইল কোর্ট। তবে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। দেদার মাস্ক ছাড়াই ঘুরতে দেখা গেছে নগরবাসীকে।

বাজারে মাস্কহীন ক্রেতার ঢল : রাজধানীর চকবাজারে সারা দেশ থেকে প্রতিদিন কয়েক লাখ খুচরা বিক্রেতা আসে পাইকারি মালামাল কিনতে। গতকাল দুপুরের পর ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায় মানুষে গাদাগাদি। হাঁটতে গেলে মানুষে মানুষে ধাক্কা লাগছে। হাতেগোনা কিছু মানুষের মুখে ছিল মাস্ক। ক্রেতা-বিক্রেতা কাউকেই স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা যায়নি। অনেক দোকানের কর্মীকেই ঠান্ডার সমস্যায় ভুগতে দেখা গেছে, তবে মুখে নেই মাস্ক। মদিনা আশিক টাওয়ারের ফয়েজ ব্যাগ হাউসের মালিক হাজী ফয়েজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা ক্রেতাদের মাস্ক পরতে বলছি। তবে বাধ্য করতে পারি না। এদিকে রাজধানীর ভাটারা এলাকার বিভিন্ন বাজার, কারওয়ানবাজার ও উত্তর বাড্ডার কাঁচাবাজার ও মাছবাজার ঘুরে ক্রেতাদের ঢল চোখে পড়লেও মাস্ক ছিল অধিকাংশ ক্রেতা-বিক্রেতার মুখে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দোকান-পাট ও সড়কেও দেখা যায়নি স্বাস্থ্যবিধি। অধিকাংশের মুখে নেই মাস্ক।

স্বাস্থ্যবিধি নেই গণপরিবহনে : নির্দেশনায় গণপরিবহনের অর্ধেক আসনে যাত্রী পরিবহন ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতের বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও সরেজমিন গতকাল দুপুরে রাজধানীতে সেই নিয়ম মানতে দেখা যায়নি কোথাও। এ ব্যাপারে গতকাল সন্ধ্যায় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে। বিকালে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার আমাদের জানিয়েছেন শনিবার থেকে গণপরিবহনের যত আসন রয়েছে তত যাত্রী নিয়ে চলাচল করতে পারবে। তবে বাসে সবার মাস্ক নিশ্চিতসহ স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে পালন করতে বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে আমরা বিষয়টি সবাইকে জানিয়ে দিয়েছি। যারা সরকারের স্বাস্থ্যবিধি মানবে না তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সড়কে পুলিশ প্রশাসনকে আমরা অনুরোধ করেছি তারা যাতে বিষয়টি দেখেন। এদিকে গতকাল দুপুরে বাণিজ্য মেলামুখী বিআরটিসির প্রতিটি বাসে দেখা গেছে উপচে পড়া ভিড়। আসন ছাড়াও ঝুলে ঝুলে যাচ্ছিল যাত্রীরা। একই চিত্র দেখা গেছে প্রগতি সরণিতে চলাচলরত সব বাসে। বাসে কিছু যাত্রীর মুখে মাস্ক থাকলেও চালক, হেলপার ও বেশিরভাগ যাত্রীর মুখে মাস্ক দেখা যায়নি। ঢাকা মেট্রো-ব ১৩-০০৯৮ নম্বরের ভিক্টর পরিবহনের হেলপারকে প্রশ্ন করলে তিনি পকেট থেকে মাস্ক বের করে হাসি দিয়ে বলেন, ‘পুলিশ ধরব না, এই যে মাস্ক!’

টিকা নেননি রেস্তোরাঁ কর্মীরাই : টিকা না নিলে কেউ হোটেল- রেস্তোরাঁয় বসে খাবার খেতে পারবেন না বলে সরকার নির্দেশনা দিলেও খোদ রেস্তোরাঁ কর্মীদেরই অনেকে নেননি টিকা। গতকাল রাজধানীর ৪টি রেস্তোরাঁ ঘুরে কোথাও ক্রেতার টিকা সনদ যাচাই করতে দেখা যায়নি। টিকা না নিয়ে রান্না থেকে খাবার পরিবেশন করছেন রেস্তোরাঁ কর্মীরা। মাস্কও দেখা যায়নি তাদের মুখে। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সিটি হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের দুই কর্মীর সঙ্গে আলাপ করে জানা যায় তারা টিকা নেননি। এ ব্যাপারে রেস্তোরাঁ মালিক ইলিয়াস হাওলাদার বলেন, তার প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ কর্মী টিকা নিয়েছেন। গতকালও পাঁচজন নিয়েছেন। দুয়েকজন বাকি থাকতে পারে। শিগগিরই তাদের টিকার ব্যবস্থা করবেন। পল্টন এলাকার বৈশাখী রেস্তোরাঁয় কোনো গ্রাহকের টিকা সনদ যাচাই করতে দেখা যায়নি। খাবারের জন্য অপেক্ষারত চার তরুণের সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেন, রেস্তোরাঁয় টিকা সনদ যাচাই করা অসম্ভব। একজনের সনদ নিয়ে আরেকজন আসতে পারে। সবাইকে তো রেস্তোরাঁ মালিক ব্যক্তিগতভাবে চেনেন না। এর চেয়ে শতভাগ মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে পারলেও কাজ হতো। সেটাই তো হচ্ছে না।

শিশুরা মাস্ক পরলেও বড়দের অনীহা : গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলে অনুষ্ঠিত হয়েছে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। এসব স্কুলে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা গেলেও স্কুলের বাইরে আমড়া বিক্রেতা, আচার বিক্রেতা বা চায়ের দোকানদার কাউকেই মাস্ক পরতে দেখা যায়নি। খিলক্ষেতের আমিরজান স্কুলে গতকাল ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চলার সময় কয়েকজন শিশু শিক্ষার্থীকে মাস্ক পরার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তারা এ প্রতিবেদককেও সব সময় মাস্ক পরতে ও স্যানিটাইজার ব্যবহারের পরামর্শ দেয়। তবে স্কুলের বাইরেই মাস্ক ছাড়া শিশুদের কাছে আচার বিক্রি করছিলেন মধ্যবয়স্ক মহসিন। তার কথায়- ‘রোগ হলে মাস্ক কি আর ঠেকাতে পারবে?’ বড়দের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতা প্রসঙ্গে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মেখলা সরকার গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শিশুরা অনেকটা স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড। তাদের কোনো শৃঙ্খলা শেখানো হলে তারা যদি সেটাকে সঠিক মনে করে, তাহলে তা মেনে চলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। দীর্ঘদিন ধরে করে। অন্যদিকে পারিপার্শ্বিক অনেক বিষয় বড়দের আচরণে পরিবর্তন ঘটায়। একটা সমস্যা বা উদ্বেগ অনেক দিন ধরে চললে বড়রা সেটার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। সমস্যা প্রতিহত করার ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পড়ে। করোনার ক্ষেত্রেও তেমনটি হয়েছে।

ঝুঁকি বাড়াচ্ছে সেলুন : সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষেত্রে অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ সেলুনগুলোতেও দেখা যায়নি কোনো স্বাস্থ্যবিধি। চুল-দাড়ি কাটা ও সেভ করার সময় গ্রাহক ও নরসুন্দরের নাক-মুখের দূরত্ব ৫ ইঞ্চির মধ্যে চলে আসলেও মাস্ক পরছেন না নরসুন্দররা। এ ব্যাপারে খিলক্ষেত ও ভাটারা এলাকার কয়েকটি সেলুনের কর্মীদের সঙ্গে আলাপ করলে কেউ বলেন, কাস্টমার চাইলে মাস্ক পরেন। কেউ আবার বলেন, সেলুনে আফটার শেভ ব্যবহার করা হয়। এটার ধারেকাছেও করোনা আসে না।

টিসিবির পণ্য কিনতে হুড়োহুড়ি : রামপুরা টিভি সেন্টার এলাকার রাস্তায় গতকাল শতাধিক নারী-পুরুষকে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে টিসিবির পণ্য কিনতে দেখা গেছে। গাদাগাদি করে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অধিকাংশ নারীর মুখ অবশ্য ওড়না বা হিজাব দিয়ে ঢাকা থাকলেও মাস্ক দেখা যায়নি পুরুষদের মুখে।

সর্বশেষ খবর