শুক্রবার, ১৪ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

বাউল সেলিম সিরিয়াল কিলার গানের ভিডিও দেখে চিহ্নিত

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাউল সেলিম সিরিয়াল কিলার গানের ভিডিও দেখে চিহ্নিত

‘ভাঙা তরী ছেঁড়া পাল’ গানের মডেল ছিলেন তিনি। পরিচয় দিতেন বাউল ফকির হিসেবে। বাউলের ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতেন দুর্ধর্ষ সিরিয়াল কিলার খ্যাত ‘সেলিম ফকির’। তার পুরো নাম মো. হেলাল হোসেন ওরফে সেলিম ফকির ওরফে বাউল সেলিম। এলাকায় তাকে খুনি হেলাল নামে চেনে মানুষ। ওই গানের সূত্র ধরেই র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন তিনি। র‌্যাব বলছে, ওই গান দেখে তার এলাকার একজন বাউল সেলিমকে খুনের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হেলাল ভেবে সন্দেহ করে তাদের কাছে তথ্য দেন। ছয় মাস ধরে অনুসন্ধানের পর র‌্যাবের গোয়েন্দারা তার অবস্থান শনাক্ত করতে সক্ষম হন এবং তিনি সেই হেলাল বলে নিশ্চিত হন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার রাতে কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলওয়ে স্টেশন থেকে হেলাল হোসেন ওরফে সেলিম ফকিরকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব।

গতকাল বেলা ১২টায় রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব জানান র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, হেলাল হোসেনের বিরুদ্ধে তিনটি হত্যা মামলা রয়েছে। এর মধ্যে একটি হত্যা মামলায় তার সাজাও দিয়েছে আদালত। এ ছাড়া আরও দুটি ফৌজদারি অপরাধের মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন হেলাল হোসেন। তার বাড়ি বগুড়ায়। এক সময় মুদি দোকান চালাতেন তিনি। পরে হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। গ্রেফতার এড়াতে ছদ্মবেশে বিভিন্ন মাজার ও রেলওয়ে স্টেশনে থাকা শুরু করেন। কেউ যাতে তার চেহারা চিনতে না পারেন, সেজন্য লম্বা দাড়ি ও চুল রাখেন। একটি বাউল গানের শুটিংয়ের সময় তাকে মডেল হিসেবে অভিনয় করানো হয়। সেই গানের ভিডিও দেখে ছয় মাস আগে এক ব্যক্তি বাউল মডেল সম্পর্কে র‌্যাবের কাছে তথ্য দেন। তখন জানানো হয়- এই বাউল মডেল সম্ভবত বগুড়ার বিদ্যুৎ হত্যা মামলার আসামি। অভিযোগ পেয়ে র‌্যাব ছায়া তদন্ত শুরু করে। একপর্যায়ে ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয় র‌্যাব। খন্দকার আল মঈন জানান, ২০০১ সালে বগুড়ায় বিদ্যুৎ হত্যাকান্ডের চার আসামির মধ্যে হেলাল একজন। ওই হত্যাকান্ডের মামলায় তার যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে। বগুড়ায় ১৯৯৭ সালে সংঘটিত আরও একটি হত্যা মামলারও আসামি তিনি। একইসঙ্গে ২০০৬ সালে রবিউল হত্যা মামলারও আসামি তিনি। এ ছাড়াও নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের একটি মামলা এবং চুরির একটি মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হেলাল এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে বলে জানিয়েছেন খন্দকার আল মঈন। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে, হত্যা মামলায় সাজা হওয়ার পর আত্মগোপনের জন্য এলাকা ছেড়ে বাউলের বেশ বেছে নেন হেলাল। এভাবেই দেশের বিভিন্ন স্টেশনে গত সাত বছর আত্মগোপনে ছিলেন হেলাল। বাউলের বেশ ধরে গান গেয়ে জীবিকাও নির্বাহ করেছেন তিনি। ১৯৯৭ সালে ২১ বছর বয়সে বিশু হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে অপরাধ জগতে পা রাখেন হেলাল হোসেন। পরে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মারামারিতে যোগ দেন তিনি। এর ফলে তিনি এলাকায় দুর্ধর্ষ হেলাল নামে পরিচিতি পান। ২০০০ সালে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের হামলায় তার বাম হাত প্যারালাইজড হয়ে যায়, যার ফলে তার নাম হয়ে যায় ‘হাত লুলা হেলাল’। ২০১০ সালে একটি চুরির মামলায় তিনি জেলে যান। ২০১১ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে তার বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়। চুরির মামলায় জামিনে বের হওয়ার সময়ই বিদ্যুৎ হত্যা মামলার রায়ে আদালত তাকে যাবজ্জীবন সাজা দেয়। এই রায়ের পর তিনি পালিয়ে যান এবং ফেরারি জীবন শুরু করেন। মূলত ২০১৫ সাল থেকে তার এই ফেরারি জীবন শুরু হয়। ফেরারি জীবনে প্রথমে হেলাল বগুড়া থেকে ট্রেনে ঢাকায় আসেন। সেখান থেকে চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামে পৌঁছে আমানত শাহ (রহ.) মাজারে কিছু দিন ছিলেন তিনি। এরপর সেখান থেকে যান সিলেটের হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজারে। সেখানে বেশ কিছু দিন ছিলেন। তারপর বিভিন্ন রেলওয়ে স্টেশনে ফেরারি জীবন শুরু হয় তার। শাহজালালের মাজার থেকে প্রথমে নারায়ণগঞ্জ স্টেশনে যান। বিভিন্ন রেলওয়ে স্টেশনে ঘুরে বাউল গান গাইতেন তিনি। ভৈরবে তিনি এক নারীকে দ্বিতীয় বিয়ে করে সংসার জীবনও শুরু করেন। কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, প্রায় ৫ বছর আগে কিশোর পলাশ ওরফে গামছা পলাশ একটি গানের শুটিং করছিলেন নারায়ণগঞ্জ রেল স্টেশনে। শুটিং চলার সময় রেললাইনের পাশ দিয়ে একজন বাউল যাচ্ছিলেন। তখন শুটিংয়ের পরিচালক তাকে গানের মিউজিক ভিডিওতে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। হেলাল মিউজিক ভিডিওতে অভিনয়ের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। ভাঙা তরী ছেঁড়া পাল শিরোনামে গানের মডেল হিসেবে পরে তাকে দেখা যায়। ইউটিউবে গানটির ভিডিওচিত্র ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। বিপুল সংখ্যক দর্শক গানটি ইউটিউবে দেখেন। ৪৬ মিলিয়ন ভিউ হয় গানটির।

সর্বশেষ খবর