শুক্রবার, ১৯ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

ঢাকা-মস্কো বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির উদ্যোগ

ব্যাংকিং সম্পর্ক গড়ে তোলার চিন্তাভাবনা

মানিক মুনতাসির

ঢাকা-মস্কো বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির উদ্যোগ

করোনা মহামারিকালে বৈশ্বিক সংকটের কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্যে তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। তবে ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হলে ঢাকা-মস্কো ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যাপক প্রভাব পড়ে। এমন কি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণকাজেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। একই সঙ্গে দেশটি থেকে জরুরি খাদ্যপণ্য গম, তেলসহ অন্যান্য জিনিসপত্র আমদানি বাধাগ্রস্ত হয়। যার ফলশ্রুতিতে বিকল্প উৎস খুঁজতে হয় বাংলাদেশকে। এতে অবশ্য বেশ বেগই পেতে হচ্ছে। বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে অনেকটা থেমে থেমে। এমন পরিস্থিতিতে ঢাকা-মস্কো বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর নতুন করে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উভয় দেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ব্যবসায়িক সংগঠনগুলো নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনাও করছে। আগামী মাসে রাশিয়ার ভøাদিভোস্টক শহরে ইস্টার্ন ইকোনমিক ফোরামের শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বর্তমানে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যাংকিং চ্যানেলে কোনো লেনদেনের পদ্ধতি চালু নেই। সেই ব্যাংকিং সম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছে উভয় দেশ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে ঢাকা শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে আগ্রহী বাংলাদেশ।

এদিকে আগামী মাসে রাশিয়ার ভøাদিভোস্টকে ইস্টার্ন ইকোনমিক ফোরামের শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এতে বাংলাদেশ ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। সপ্তম এই ইস্টার্ন ইকোনমিক ফোরামের সম্মেলন আগামী ৫ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হওয়ার কথা রয়েছে। এতে বিশ্বের ৭০টিরও বেশি ব্যবসায়িক ইভেন্ট থাকবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এতে অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ইস্টার্ন ইকোনমিক ফোরাম হলো একটি আন্তর্জাতিক ফোরাম, যা দেশের সুদূর পূর্বাঞ্চলে বিদেশি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে ২০১৫ সাল থেকে ভøাদিভোস্টকে তাদের বার্ষিক সম্মেলন করে আসছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ইউক্রেনের যুদ্ধের পর বাংলাদেশের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যে অনেক নতুন সুযোগ ও চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি হচ্ছে। আমরা বেলারুশ, কাজাখস্তানের মতো ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াতে চাই। এ জন্য ইস্টার্ন ইকোনমিক ফোরামের শীর্ষ সম্মেলনের মতো বৃহৎ এ ফোরামটি আমাদের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি প্ল্যাটফরম। যার মাধ্যমে আমরা আমাদের সম্ভাবনাগুলোকে খুঁজতে পারব। সূত্রমতে, ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন হলো ইউরেশিয়াজুড়ে অবস্থিত কিছু পোস্ট-সোভিয়েত রাষ্ট্রের একটি অর্থনৈতিক ইউনিয়ন। ইউরেশিয়ান অর্থনৈতিক ইউনিয়নের চুক্তিটিতে যথাক্রমে বেলারুশ, কাজাখস্তান এবং রাশিয়ার নেতারা ২০১৪ সালের ২৯ মে স্বাক্ষর করেন। ইতোমধ্যে, বিশ্বের প্রায় ৪০টি দেশ আসন্ন ইস্টার্ন ইকোনমিক ফোরাম সম্মেলনে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে। রাশিয়ান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা এবং আয়োজক কমিটির প্রধান অন্তন কোব্যাকভ একটি চিঠিতে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিকে এ সম্মেলনে অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ জানান। চিঠিতে বলা হয়, আসন্ন এ সম্মেলন ২০২২-এর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক সম্মেলন। আমরা আপনাকে কার্যকরভাবে কাজ করতে এবং সম্ভাব্য অংশীদারদের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক তৈরি করতে, বিনিয়োগ চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে এবং দৃষ্টিভঙ্গি ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্য একটি প্ল্যাটফরম দেওয়ার চেষ্টা করব। প্রায় ৪ হাজার প্রতিনিধি এই শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এ ছাড়া মস্কোতে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য, অর্থনীতি, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি বিষয়ে আন্তসরকার কমিশন চুক্তি হয়েছে ২০১৭ সালের ১৯ জানুয়ারি। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা নিয়ে ২০১৮ সালের ২৪ অক্টোবর মস্কোতে বৈঠকও হয়েছে বাংলাদেশের। রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি ব্যাংকিং সম্পর্ক নেই বাংলাদেশের। টেলিগ্রাফিক ট্রান্সফারের (টিটি) মাধ্যমে লেনদেন করতে হয়। এতে নানা সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়ছিল। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এতে বড় ধরনের ছেদ ঘটিয়েছে বলে মনে করে উভয় দেশ। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্র জানায়, পাঁচ বছর আগে রাশিয়া থেকে বাংলাদেশের আমদানি ছিল ৪৩ কোটি ৭১ লাখ ডলারের পণ্য। ২০২০-২১ অর্থবছরে এসে আমদানি ৩ কোটির চেয়ে একটু বেড়ে দাঁড়ায় ৪৬ কোটি ৬৭ লাখ ডলার। অর্থাৎ আমদানি ও রপ্তানির মধ্যে রপ্তানির দিক থেকে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশ ইতিবাচক অবস্থানে আছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রথমবার উভয় দেশের বাণিজ্য শত কোটি ডলার পেরিয়ে দাঁড়ায় ১১১ কোটি ৩৮ লাখ ডলার। এর পর থেকে প্রতিবছরই এ বাণিজ্য শত কোটি ডলারের বেশি লেনদেন হচ্ছে। ইউক্রেনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য খুব বড় নয়। পাঁচ বছর ধরে এই বাণিজ্যের পরিমাণ ৩০ থেকে ৪০ কোটি ডলারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের তুলনায় ২০২০-২১ অর্থবছরে ইউক্রেনে রপ্তানি দ্বিগুণ ছাড়িয়ে গেলেও পরিমাণ খুবই কম। ইউক্রেনে রপ্তানির তুলনায় দেশটি থেকে বাংলাদেশের আমদানির পরিমাণ ১৫ থেকে ২০ গুণ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরে ইউক্রেনে রপ্তানির চেয়ে সেখান থেকে আমদানি হয়েছে ১৩ গুণ বেশি পণ্য। তার আগের অর্থবছরে ইউক্রেন থেকে ২০ গুণ বেশি পণ্য আমদানি হয়েছিল। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইপিবি সূত্র জানায়, রাশিয়ায় বাংলাদেশ রপ্তানি করে বস্ত্রপণ্য, চিংড়ি, পাট, সুতা, চামড়া, মোটর পার্টস, হোম টেক্সটাইল, টেরিটাওয়েল, ফুটওয়্যার, সিনথেটিক দড়ি, টেবিলওয়্যার ইত্যাদি। আর রাশিয়া থেকে বাংলাদেশ আমদানি করে গম, সার, লোহা, রাসায়নিক পণ্য, প্লাস্টিক, ইস্পাত ইত্যাদি। উভয় দেশ তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির ব্যাপারে নতুন কিছু কার্যকর উদ্যোগ নিতে চায় জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র।

সর্বশেষ খবর