বৃহস্পতিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

ডেঙ্গু আতঙ্ক বাড়ছেই রাজধানীতে

কেড়ে নিচ্ছে শিশুর প্রাণ, জ্বর এলে দ্রুত টেস্টের তাগিদ চিকিৎসকদের, আক্রান্ত হলে অবহেলা না করার পরামর্শ

জয়শ্রী ভাদুড়ী

ডেঙ্গু আতঙ্ক বাড়ছেই রাজধানীতে

বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান স্বপ্নিল বাহাদুর (৭) রাজধানীর বিএফ শাহীন স্কুলের ক্লাস ওয়ানে পড়ত। জ্বর, বমি ও পেট ব্যথা নিয়ে ৮ জুলাই রাজধানীর আদদ্বীন হাসপাতালে ভর্তি হয় স্বপ্নিল। ডেঙ্গু টেস্ট নেগেটিভ এলেও তার ব্লাডে প্লাটিলেটের মাত্রা ছিল ৭০ হাজার। প্লাটিলেট দেওয়ার পর তাকে সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে ডেঙ্গু টেস্টে রিপোর্ট পজিটিভ আসে। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৯ জুলাই মারা যায় স্বপ্নিল। মৃত্যুর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় ডেঙ্গু শক সিনড্রোম।

স্বপ্নিলের মতো সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের ক্লাস ওয়ানের শিক্ষার্থী আরফিয়ার ডেথ সার্টিফিকেটে লেখা হয়েছিল মৃত্যুর কারণ ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। তিন দিনের জ্বর ও কাশি নিয়ে রাজধানীর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ সেপ্টেম্বর মারা গেছে সে। স্বপ্লিলের মতো বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান আরফিয়া। হঠাৎ দুই-তিন দিনের জ্বরে একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে দিশাহারা স্বপ্নিল ও আরফিয়ার পরিবার।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, গত ৯ মাসে ডেঙ্গুতে মারা গেছে ৩৯ জন, এর মধ্যে অন্তত ৮ জন শিশু। যদিও স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যের বাইরেও ডেঙ্গুতে শিশু মৃত্যুর তথ্য রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে এখন পর্যন্ত চারজন শিশু মারা গেছে। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, সে সংখ্যা ৭। এ ছাড়া স্বপ্নিলের মৃত্যুর তথ্যও নেই স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যে। স্বাস্থ্য অধিদফতর ঢাকা শহরের মাত্র ৩৩টি হাসপাতালের ডেঙ্গু রোগীর তথ্য দেয়।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ায় ডেঙ্গুতে শিশুদের অবস্থা বেশি নাজুক। শিশুদের ডেঙ্গুর লক্ষণ বুঝতে দেরি হওয়ায়, দেরিতে হাসপাতালে নেওয়ার কারণে তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি। ইউজিসি অধ্যাপক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শিশুরা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে বিপদ বেড়ে যায়। ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হলে ইন্টারনাল রক্তক্ষরণ অনেক বেশি হয়। শিশুরা অল্পতেই শকে চলে যায়। কিডনি, লিভার ফেইলিউর শিশুদের খুব দ্রুত হয়। সে কারণে ডেঙ্গুতে শিশুদের মধ্যে মৃত্যুহার বেশি। তিনি আরও বলেন, দিনের বেলা শিশুরা ঘুমালে মশারি টানাতে হবে, ফুল প্যান্ট পরিয়ে রাখতে হবে। জ্বর এলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কোথাও স্বচ্ছ পানি জমিয়ে রাখা যাবে না। সচেতন থেকে ডেঙ্গুকে রুখতে হবে। এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৯ হাজার ৫০০ জনের বেশি মানুষ। এ বছরের শুরুতে প্রতি মাসে দু-একজন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি থাকলেও গত আগস্টে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে ডেঙ্গু রোগী ১০০ ছাড়ায়। হাসপাতালের তথ্য বলছে, এ বছর এখন পর্যন্ত ২৬৬ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছে ৭ শিশু। বর্তমানে হাসপাতালটিতে ভর্তি আছে ২৮ শিশু, যদিও হাসপাতালটির ডেঙ্গু সেলে বেড আছে ১২টি। বাকি রোগীদের ডেঙ্গু সেলের বাইরে অন্য ওয়ার্ডে রাখা হচ্ছে। বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘শিশুদের জ্বর হলেই ডেঙ্গু টেস্ট করতে হবে। বেশি বেশি পানি ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে। প্রচণ্ড পেট ব্যথা, বমি, প্রচণ্ড মাথাব্যথা-এসব লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে হাসপাতালে এলে সুস্থ হয়ে যায় রোগীরা। যত দেরি হয় তত ঝুঁকি বাড়ে।’

শিশু হাসপাতালের বাইরে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতাল ও মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও শিশু রোগী বাড়ছে বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় নজর রাখতে হাসপাতালগুলোকে চিঠি দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। অধিদফতরের পরিচালক (সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে হাসপাতালের পরিচালকদের চিঠি পাঠানো হয়েছে। ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কিট, চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সংগ্রহ করে রোগী ম্যানেজমেন্টের বিষয়ে নজর রাখতে বলা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, শিশুদের ফ্লুয়িড ম্যানেজমেন্ট ঠিকমতো না হলে ঝুঁকি বেড়ে যায়। দেরি হয়ে গেলে রোগীর পরিস্থিতি খারাপের দিকে চলে যায়। শিশুদের মৃত্যুর পেছনে এটা একটা বড় কারণ। জ্বর এলে অভিভাবকরা অবহেলা করে দেরি করে হাসপাতালে আসছেন। শুরু থেকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না হওয়ায় রোগীর পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। তাই জ্বর হলে শিশুদের দ্রুত হাসপাতালে আনতে অনুরোধ করা হচ্ছে।

২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ৩৮৯ ডেঙ্গু রোগী : হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চাপ বেড়েই চলেছে। গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ৩৮৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকা ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৫১ জনে। চলতি মাসের শুরুতে এই সংখ্যা ছিল ৭৮১ জন। তবে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে কারো মৃত্যু হয়নি। হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে ৯২৯ জন ঢাকায় ও ৩২২ জন অন্যান্য বিভাগের হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।

গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় ২৬৪ জন ও ঢাকার বাইরে ১২৫ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছর ডেঙ্গুতে দেশে ৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। মোট হাসপাতালে ভর্তি হন ৯ হাজার ৮৩৭ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৮ হাজার ৫৪৭ জন।

সর্বশেষ খবর