শনিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

স্ট্রোক আক্রান্ত তরুণ বাড়ছে

ঢাকার বাইরে রয়েছে চিকিৎসাসেবার অপ্রতুলতা

জয়শ্রী ভাদুড়ী

স্ট্রোক আক্রান্ত তরুণ বাড়ছে

নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীর বাসিন্দা আট বছরের ইয়াছির আলী। খেলতে খেলতে মাঠেই জ্ঞান হারায় সে। এরপর দেখা যায় সে বাম হাত, বাম পা নাড়াতে পারছে না এবং মুখ ডান দিকে বেঁকে গেছে। স্থানীয় হাসপাতালের চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে নিয়ে আসেন অভিভাবকরা। হাসপাতালে পরীক্ষায় ধরা পরে স্ট্রোকে আক্রান্ত শিশু ইয়াছির।

ইয়াছিরের রোগ বিষয়ে হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক নিউরোলজি বিভাগের কনসালটেন্ট ডা. শ্যামল সরকার বলেন, ‘এই রোগী আমাদের কাছে আসলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায় তার স্ট্রোক হয়েছে। এত অল্প বয়সে স্ট্রোকের রোগী সংখ্যায় কম হলেও এখন কিছুটা বাড়ছে। জন্মগত বিভিন্ন ত্রুটি, রক্তরোগ, আয়রন কম, হৃদরোগ থাকলে শিশুরা স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। ইয়াছির ময়াময়া রোগে আক্রান্ত ছিল। এই রোগের কারণে তার ব্রেনের এক পাশের রক্তনালি সরু হয়ে যাচ্ছিল। ব্রেনের ওই অংশে রক্ত না যাওয়ায় সে স্ট্রোক করেছে। পরবর্তীতে নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের শিশু নিউরো সার্জারি বিভাগের সহায়তায় তার অপারেশন করা হয়। অপারেশন না করলে পুনরায় স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায় এবং জীবন বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে।’

বয়স বাড়লে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। দেশে তৃতীয় মৃত্যুর কারণ হিসেবে স্ট্রোককে দায়ী করা হয়। কিন্তু ৪০ বছরের নিচে বয়সী তরুণ এবং শিশুরা স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছে। এই বয়সী রোগীদের আক্রান্ত হওয়ার হার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। স্ট্রোকের চিকিৎসা ঢাকার বাইরে অপ্রতুল। ‘সময় মূল্যবান’ এ বছরের স্ট্রোক দিবসের প্রতিপাদ্য হলেও দূর-দূরান্ত থেকে ঢাকাতে রোগী নিয়ে আসতে রাস্তাতেই নষ্ট হচ্ছে জীবন বাঁচানোর সুযোগ। সচেতন থেকে স্ট্রোক প্রতিরোধ করায় জোর দিয়ে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব স্ট্রোক দিবস। দিবস উপলক্ষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতাল, ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতালসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। পঞ্চগড়ে চা শ্রমিকের কাজ করতেন আলিফ হোসেন (২৩)। কাজ থেকে ফিরে ঘরের মেঝেতে হঠাৎ অচেতন হয়ে পড়েন তিনি। স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়ার পর জ্ঞান ফিরলেও শরীরের এক পাশ অবশ হয়ে যায়। চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে পঞ্চগড় থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। আলিফ হোসেনের স্ত্রী সুরাইয়া রহমান বলেন, ‘কাজ থেকে হাত মুখ ধুয়ে ঘরের মেঝেতে দাঁড়াতেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে সে। চোখে মুখে পানি ছিটালেও জ্ঞান না ফেরায় আমি চিৎকার করে প্রতিবেশীদের ডাকলে সবাই ওকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। প্রথমে ডাক্তাররা বুঝতে পারছিলেন না আলিফের কী হয়েছে। ডান হাত অবশ হয়ে যাওয়া দেখে স্ট্রোক সন্দেহ করে দ্রুত ঢাকা নিয়ে আসতে বলেন তারা। আত্মীয়-স্বজনের কাছে ঋণ করে আমি তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসি। স্ট্রোক হওয়ার পর হাসপাতালে আনতে দেরি হওয়ায় বিপদ বেড়েছে বলে জানান চিকিৎসকরা। এত অল্প বয়সে স্ট্রোক হয় এটা শুনে অবাক হয়েছি। বেঁচে আছে কিন্তু কথা বলতে পারছে না, হাত-পাও নাড়াতে পারছে না।’ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. এম এস জহিরুল হক চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এত দিন সবার ধারণা ছিল স্ট্রোক শুধু বয়স্ক ব্যক্তিদের হয়। তবে সেই ধারণা এখন পরিবর্তন হয়েছে। তরুণদের স্ট্রোকের সংখ্যা বেড়েছে। ৪০ বছরের নিচে স্ট্রোক রোগী শতকরা ১০ ভাগ। একই সঙ্গে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুও বেড়েছে। ৪০ বছরের নিচে। স্ট্রোক দুই ধরনের হয় রক্তজমাট বেঁধে ও রক্তনালি ফেটে গিয়ে।’ দেশে অসংক্রামক রোগের মধ্যে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ৪০ বছরে রোগটির তীব্রতা বেড়েছে শতভাগ। বর্তমানে প্রতি চারজনে একজন স্ট্রোকের ঝুঁঁকিতে রয়েছেন। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে স্ট্রোকের মাত্রা কমেছে ৪২ শতাংশ। ২০৫০ সালে বিশ্বে স্ট্রোকের মোট রোগীর ৮০ শতাংশই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের মধ্যে ৪৮ শতাংশই স্ট্রোকের ঝুঁকিতে রয়েছেন। অনিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপনের কারণে প্রতি ১০০ জনে ৩৬ জন স্ট্রোকের শিকার হচ্ছেন। এ ছাড়া রোগটিতে আক্রান্ত ১৯ শতাংশের দেহে অতিরিক্ত মেদ, ১৭ শতাংশ মানসিক চাপে ভোগেন। এ ছাড়া ২৩ শতাংশ জাঙ্ক ফুডে আসক্ত।’

ঢাকার বাইরে স্ট্রোকের চিকিৎসা অপ্রতুল। স্ট্রোক হলে ব্রেনে প্রতি মিনিটে ২০ লাখ নিউরন ধ্বংস হয়। তাই প্রথম উপসর্গ দেখা দেওয়ার পরের চার ঘণ্টা গোল্ডেন আওয়ার। এ সময় রোগীকে হাসপাতালে আনলে ওষুধের মাধ্যমে কিংবা অপারেশন করে বা ওষুধের মাধ্যমে রোগীকে সুস্থ করতে পারেন চিকিৎসকরা। কিন্তু দেরি হলে পঙ্গুত্ব ও জীবনহানির ঝুঁকি বেড়ে যায়। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের ইন্টারভেনশন নিউরোলজি বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. হুমায়ুন কবির হিমু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, স্ট্রোকের রোগীকে দ্রুত নিয়ে আসতে এর লক্ষণগুলো জানা জরুরি। মুখ এক পাশে বেঁকে যাওয়া, হাত-পা অবশ হয়ে যাওয়া, কথা জড়িয়ে যাওয়া, ঠিক মতো সাড়া না দেওয়া, একটা জিনিস দুটা দেখতে পাওয়া, অনেক সময় দেখতে পান না রোগী। এ ছাড়া শরীরে ভারসাম্য না পেলে বুঝতে হবে ওই ব্যক্তি স্ট্রোক করেছে। স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার সাড়ে চার ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে আনলে আধুনিক চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীকে পুরোপুরি সুস্থ করা যায়। কিন্তু দেরি হলে জীবন বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। ইউনাইটেড হাসপাতালের স্ট্রোক সেন্টারের কো-অর্ডিনেটর ডা. এস এম সাদলী বলেন, স্ট্রোক আক্রান্ত হওয়া রোগীদের ১৫-২০ ভাগের বয়স ১৮-৫০ বছরের মধ্যে। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তে উচ্চ মাত্রায় কোলেস্টরেল, ধূমপান ও স্থূলতা এই পাঁচটি বিষয় স্ট্রোকের রিস্ক ফ্যাক্টর। ইয়াবা, কোকেন, অ্যালকোহলে আসক্ত ব্যক্তিরা স্ট্রোকের শিকার হয়। এ ছাড়া হৃদরোগ, বাতজ্বর স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। চর্বি জাতীয় খাবার কমিয়ে শাক-সবজি ফলমূল খেতে হবে, নিয়মিত ৪০ মিনিট হাঁটতে হবে।

সর্বশেষ খবর