শিরোনাম
শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

যৌতুকে বাড়ছে নারী নির্যাতন

সন্তান ও পরিবারের লোকজনও হামলার শিকার

জিন্নাতুন নূর

যৌতুকে বাড়ছে নারী নির্যাতন

দেশজুড়ে নারী নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে যৌতুকের কারণে নববধূ থেকে শুরু করে একাধিক সন্তানের মা কেউই শারীরিক-মানসিক নির্যাতন থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। যৌতুকের লোভে স্ত্রী, সন্তান এবং স্ত্রীর পরিবারের লোকজনদের ওপরও হামলে পড়ছে লোভী স্বামী এবং শ্বশুড়বাড়ির লোকজন। পারিবারিক বা প্রেমের বিয়ে, যা-ই হোক না কেন ভয়াবহ এ সামাজিক ব্যাধির ছোবলে একের পর এক গৃহবধূর প্রাণ যাচ্ছে। এ অবস্থায় দেশে আজ পালিত হবে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘সবার মাঝে ঐক্য গড়ি, নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধ করি’। সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনাকালে অর্থনৈতিক অবস্থা বিপর্যস্ত হওয়ায় যৌতুক দেওয়া-নেওয়ার ঘটনা স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও বৃদ্ধি পেয়েছে।

সম্প্রতি জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে যৌতুক মামলা তুলে না নেওয়ায় এক নারীর বাড়িঘরে হামলা ও মারধর করার অভিযোগ উঠেছে তার সাবেক স্বামী সোহেলের বিরুদ্ধে। উপজেলার মহাদান ইউনিয়নের ধোপাদহ গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। জানা যায়, ২০১৯ সালে সোহেলের সঙ্গে ভুক্তভোগীর বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকেই যৌতুকের জন্য সেই গৃহবধূকে শারীরিক নির্যাতন করে আসছিলেন সোহেল। মারধর সহ্য না করতে পেরে বাবার বাড়ি গিয়ে সোহেলের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পরে তাদের সন্তান জন্মের পর গৃহবধূকে ডিভোর্স দেন। মামলা তুলে নেওয়ার জন্য সেই নারী ও তার পরিবারকে হুমকি দিয়ে আসছিলেন সোহেল।

সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় যৌতুক না পেয়ে এক গৃহবধূর শরীরে ফুটন্ত গরম পানি ঢেলে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভুক্তভোগী মহিলা কলেজের স্নাতকের শিক্ষার্থী। বিপ্লব দাস নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে তিন বছর আগে তার বিয়ে হয়। বিয়েতে মেয়েটির বাবা নগদ অর্থ আর বিভিন্ন জিনিসপত্র মিলিয়ে ৩ লাখ টাকার যৌতুক দেন। কয়েকদিন না যেতেই আবার ৫ লাখ টাকা যৌতুক দাবি করেন বিপ্লব। আর টাকা দেবেন না বলে জানালে তাদের কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে ১০ নভেম্বর বিপ্লব মেয়েটির শরীরে গরম পানি ছুড়ে মারলে ঝলসে যায় তার শরীরের অর্ধেক।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যে, ২০২১ সালে একজন কন্যাশিশুসহ  যৌতুকের কারণে নির্যাতন করা হয় ১৩৮ জনকে। ৪৫ জনকে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় শিক্ষিত যে ছেলেরা আগে যৌতুকের জন্য স্ত্রীর ওপর চাপ দেওয়ার কথা ভাবতেন না তারাও এখন স্ত্রীকে শ্বশুরবাড়ি থেকে অর্থ এনে দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। শিক্ষিত অনেক পুরুষ এখনো শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তির প্রতি লোভ ছাড়তে পারেন না। এসব কিছুই করোনাকালে যৌতুক প্রথাকে আরও উসকে দিয়েছে। তারা আরও জানান, শুধু গ্রামাঞ্চলেই নয়, ঢাকাসহ অন্য বিভাগীয় শহরগুলোতেও যৌতুকের জন্য কনেপক্ষকে বিব্রত হতে হয়। একসময় যৌতুক হিসেবে কনেপক্ষের কাছ থেকে বরপক্ষ যৌতুক হিসেবে নগদ অর্থ ও আসবাবপত্র নিলেও বর্তমানে নগদ অর্থ ছাড়াও দামি উপহারসামগ্রী, জমি, যানবাহন ও ফ্ল্যাট দাবি করছে। আবার শিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারগুলোয় শ্বশুরবাড়ির কটুকথার ভয়েও মেয়ের মা-বাবা বিয়ের সময় সংসার গুছিয়ে দেওয়ার নাম করে পাত্র ও তার পরিবারের জন্য দামি আসবাবপত্র, ফ্ল্যাট, গাড়ি ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র কিনে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু এত কিছু করার পরও অনেক সময় পাত্র ও তার পরিবারের লোকজন আরও যৌতুকের জন্য ভুক্তভোগী মেয়ে ও তার পরিবারকে চাপ দিচ্ছেন। ছেলেপক্ষের চাহিদার তালিকা যেন শেষই হতে চায় না। কেউ কেউ ছেলের বিদেশে যাওয়ার জন্য যাবতীয় খরচ, কারও কারও ক্ষেত্রে ব্যবসা করার জন্য মেয়ের পরিবারের কাছ থেকে অর্থ চেয়ে নেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যৌতুক প্রতিরোধে যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮ থাকলেও আইনটির নানা ফাঁকফোকর থাকায় অনেক ক্ষেত্রে অপরাধী পার পেয়ে যাচ্ছে। এ আইনে যৌতুকের সংজ্ঞা নির্ধারণে বলা হয়েছে, ‘মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (শরিয়াহ) প্রযোজ্য হয় এমন ব্যক্তিগণের ক্ষেত্রে দেনমোহর, মোহরানা অথবা বিবাহের সময় বিবাহের পক্ষগণের আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বা শুভাকাক্সক্ষী কর্তৃক বিবাহের কোনো পক্ষকে প্রদত্ত উপহারসামগ্রী যৌতুকের অন্তর্ভুক্ত হবে না।’ আর আইনের এ ব্যাখ্যার সুযোগে মূল্যবান অনেক সামগ্রী যৌতুকের নামে এখন দেওয়া-নেওয়া চলছে। প্রচলিত আইন অনুযায়ী, বিয়েতে যৌতুক দাবি, গ্রহণ বা প্রদানের পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে সহায়তা করার অপরাধে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদন্ড ও ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো অনেক সময় যৌতুকের অভিযোগ আমলে নিচ্ছে না এটি দুঃখজনক। আবার কিছু ক্ষেত্রে নিরপরাধ ব্যক্তিদের এ মামলায় জড়ানো হচ্ছে। এর ফলে প্রকৃত মামলাগুলো গতি হারিয়ে ফেলছে। তবে ঘৃণ্য এ প্রথা শুধু আইন প্রয়োগে বন্ধ করা যাবে না। এজন্য প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা।’

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর