রবিবার, ২২ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

অচল যন্ত্রাংশের সচল বাজার ধোলাইখাল

রাশেদ হোসাইন

অচল যন্ত্রাংশের সচল বাজার ধোলাইখাল

ধোলাইখালে গাড়ির যন্ত্রাংশের একটি দোকান -বাংলাদেশ প্রতিদিন

পুরান ঢাকার ধোলাইখালে মেলে অচল গাড়ি সচল করা, গাড়ির নকশা পরিবর্তন এবং মোটরগাড়ির যন্ত্রাংশ। মোটরগাড়ির যে কোনো সমস্যার সমাধানও সম্ভব যন্ত্রাংশের এ মার্কেটে। এটি দেশের প্রধান মোটরগাড়ির মেরামত ও মোটর যন্ত্রাংশ বিক্রয়কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

১৯৬৬ সালে ৪০ থেকে ৫০টি কারখানার মাধ্যমে এ ব্যবসার শুরু হয়। তখন ধোলাইখালের যন্ত্রাংশের মার্কেটটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময় শুধু বাস ও ট্রাকের যন্ত্রাংশই পাওয়া যেত। সময়ের ব্যবধানে ব্যক্তিগত গাড়ি বৃদ্ধির সঙ্গে বিভিন্ন যন্ত্রাংশের প্রয়োজনীয়তা বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে প্রসারিত হতে থাকে ধোলাইখালের যন্ত্রাংশের ব্যবসা। পুরনো গাড়ির যন্ত্রাংশ পাওয়ার শেষ আশ্রয়স্থল বলা হয়ে থাকে এ মার্কেটকে। বর্তমানে এ এলাকায় রয়েছে অসংখ্য ছোট-বড় ওয়ার্কশপ। পুরান ঢাকার নাসির উদ্দিন সরদার লেন, টিপু সুলতান রোড থেকে শুরু করে নারিন্দা পর্যন্ত এই ব্যবসার প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রাংশ উৎপাদন ও মেরামতে ব্যস্ত সময় পার করছে। মোটরগাড়ির যন্ত্রাংশের মার্কেটটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ২০ বছরের মাথায় সারা দেশে ধোলাইখালের নাম ছড়িয়ে পড়ে। দেশের যোগাযোগ খাত অনেক ক্ষেত্রে রিকন্ডিশন্ড যানবাহনের ওপর নির্ভরশীল। আর এ যানবাহনের অনেক যন্ত্রাংশই একটা সময় পরে নতুন পাওয়া যায় না। ফলে রিকন্ডিশন্ড যানবাহনের মালিকদের শেষ ভরসাস্থল যন্ত্রাংশের এই মার্কেট। ধোলাইখালে মোটরগাড়ির যন্ত্রাংশের ব্যবসা জমজমাট হয়ে উঠেছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে রাস্তার মাঝে রোড ডিভাইডারে চলে এই ব্যবসা। নগরীর অন্যতম যন্ত্রপাতির ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র পরিণত হয়েছে এটি। ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৫ হাজার দোকান রয়েছে ধোলাইখালের মার্কেটে। এখানে মালিক-শ্রমিকসহ ৫০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। সারা দেশে ৮ থেকে ৯ লাখ লোক এই সেক্টরে জড়িত। ব্যবহারের অনুপযোগী যানবাহন থেকে এ মার্কেটে পুরনো যন্ত্রাংশগুলো সংগ্রহ করা হয়। এসব পণ্য বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টসহ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে নিলামের মাধ্যমে ক্রয় করা হয়। গাড়ির যন্ত্রাংশ পাওয়ার আরও একটি উপায় দুর্ঘটনাজনিত কারণে বাতিল হওয়া গাড়ি। এসব গাড়ির ভালো যন্ত্রাংশ পুনরায় ব্যবহার করা হয় এবং বাকি অংশটুকু স্ক্র্যাপ আকারে বিক্রি করে দেওয়া হয়।

এ মার্কেটে সব ধরনের যানবাহনের ইঞ্জিনের নাট, চেসিস, বিয়ারিং, টায়ার ও স্প্রিংসহ ছোট-বড় যন্ত্রাংশ পাওয়া যায়। এখানে যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ শিল্প, গৃহস্থালি, কৃষি, বৈদ্যুতিক, যানবাহন, পণ্য তৈরি হয়। এসবের মধ্যে কাগজ ও সিমেন্ট কারখানার যন্ত্রাংশ, ফ্যান্সি লাইট ফিটিংস, নির্মাণযন্ত্র, ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজার, আয়রন চেইন, কার্বন রড, অটোমোবাইল পার্টস, বৈদ্যুতিক ও স্টেনলেস স্টিলওয়্যার তৈরি হয়। ধোলাইখালে উৎপাদিত পণ্য দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে, যা দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা পূরণ করে আমদানি-নির্ভরতা কমিয়েছে।

ব্যবসা সম্প্রসারিত হওয়ার ফলে নির্দিষ্ট পণ্যের দোকানও গড়ে উঠেছে। কোনো দোকান রিয়ারিং সংগ্রহ ও বিক্রি করছে। আবার কিছু দোকান শুধু টায়ার অথবা স্টিয়ারিং বিক্রি করছে। এভাবেই অনেক ব্যবসায়ী নির্দিষ্ট ধরনের যন্ত্রাংশ বিক্রি করছেন। পুরনো গাড়িকে নতুন আদল দেওয়া, গাড়ির ভিতরের ও বাইরের সাজসজ্জা, অচল গাড়ি সচল করা, মেরামতসহ যে কোনো কাজ দক্ষতার সঙ্গেই করে থাকেন এ মার্কেটের কারিগররা। অথচ তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। কাজ করার মাধ্যমে যতটুকু দক্ষতা অর্জন করেছে তা দিয়ে চলছে এ কাজ। কর্মসংস্থান ও দক্ষ শ্রমিক তৈরিতে ধোলাইখাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পেলে গাড়িও তৈরি সম্ভব বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

হালকা প্রকৌশল শিল্পমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্ডাস্ট্রিজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিইআইওএ) সভাপতি আবদুর রাজ্জাক বলেন, গার্মেন্টের পর দ্বিতীয় পণ্য হিসেবে এ খাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এ শিল্পে সারা দেশে গড়ে উঠেছে ৫০ হাজারের বেশি কারখানা। ৪০ থেকে ৫০টি কারখানার মাধ্যমে শুরুটা ধোলাইখাল থেকে। জাতীয় অর্থনীতির ২.৫ শতাংশ এ খাত থেকে আসে। জিডিপিতে এ খাতের ৩ শতাংশ অবদান রয়েছে। এসব যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ শিল্প, গৃহস্থালি, কৃষি, বৈদ্যুতিক, যানবাহন, খেলনা ও চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। এসবের মধ্যে কাগজ ও সিমেন্ট কারখানার যন্ত্রাংশ, বাইসাইকেল, ফ্যান্সি লাইট ফিটিংস, নির্মাণযন্ত্র, ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজার, আয়রন চেইন, কার্বন রড, অটোমোবাইল পার্টস, বৈদ্যুতিক ও স্টেইনলেস স্টিলওয়্যার রপ্তানি হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হচ্ছে এসব পণ্য।

সর্বশেষ খবর