রবিবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

দূষণে নাভিশ্বাস হালদার

পড়ছে তামাকবর্জ্য, চলছে ইঞ্জিনচালিত নৌকা, তোলা হচ্ছে বালি বিপাকে মা-মাছ, কমছে ডিম উৎপাদন, মরছে ডলফিন

রেজা মুজাম্মেল, চট্টগ্রাম

দূষণে নাভিশ্বাস হালদার

উপমহাদেশর প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র এবং বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হালদা নদী সুস্থ রাখার প্রথম শর্তই হলো দূষণমুক্ত পরিবেশ। কিন্তু দেশের অন্যতম মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা আকণ্ঠ দূষণে নিমজ্জিত। নগর ও স্থানীয় আবাসিক-বাণিজ্যিক বর্জ্যরে সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে উজানে তামাক চাষের কীটনাশকের নির্যাস। একরের পর একর তামাক চাষের বিষাক্ত কীটনাশকের পানি সরাসরি পড়ছে নদীতে। ফলে দূষণে নাভিশ্বাস এখন বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজের। প্রতিনিয়তই হচ্ছে বেদখল, চলছে ইঞ্জিনচালিত নৌকা, তোলা হচ্ছে বালি, নষ্ট হচ্ছে মা-মাছের কূপ, কমছে ডিম, দূষণে মরছে ডলফিন- এসব কারণে হুমকির মুখে হালদার ভবিষ্যৎ।

জানা যায়, ২০১৬ সাল থেকে ‘হালদা নদীর উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও হালদা উৎসের পোনার বাজার সম্প্রসারণ’ শীর্ষক ভ্যালু চেইন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। সরকারি উন্নয়ন সংস্থা পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) অর্থায়নে, ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (আইডিএফ) উদ্যোগে আর মানিকছড়ি উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় উজান এলাকার জমিগুলোতে সবজি চাষ করা হয়। ২০২০ সালের দিকে হালদার উজান মানিকছড়ি অংশে তামাকের চাষাবাদ শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। কিন্তু গত বছর থেকে ফের শুরু হয় তামাক চাষ। গত নভেম্বর থেকে মানিকছড়ি এলাকার বড় একটি অংশের চাষিদের তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করে টোব্যাকো কোম্পানিগুলো। চলতি মৌসুমে ঘোরখানা, আসাদতলী, কালাপানি, তুলাবিল, ছদুরখীল এলাকায় ৩৫ হেক্টর জমিতে ২৮ জন কৃষক নতুনভাবে তামাক চাষে জড়িয়ে পড়েন। তামাক চাষের কীটনাশকের তরল বর্জ্য সরাসরি পড়ছে নদীতে। স্থানীয় প্রবীণ ডিম সংগ্রহকারী কামাল উদ্দিন সওদাগর বলেন, হালদা নদীতে ইঞ্জিনচালিত বোট চলাচল, বালি উত্তোলন, জাল বসিয়ে মা-মাছ নিধনের সঙ্গে যোগ হয়েছে তামাক চাষের কীটনাশকের বর্জ্য। এতে নদীটির নাভিশ্বাস অবস্থা তৈরি হচ্ছে। চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী বলেন, ‘হালদায় সারা বছরই খননযন্ত্র, যান্ত্রিক নৌযান চলাচল সম্পূর্ণ নিষেধ। এর পরও অনেকে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে এ অন্যায় কাজ চলছে। আমরা নিয়মিত মনিটরিং করে এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করি। তবে এ ব্যাপারে স্থানীয়দের অধিক হারে সচেতন থাকতে হবে। অন্যথায় নদীটিকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে।’ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, হালদা নদীর এখন প্রধান সমস্যা তামাক চাষের কীটনাশকের বর্জ্য। এর সঙ্গে আছে আবাসিক ও বাণিজ্যিক বর্জ্য। ফলে বহুমুখী সমস্যা ভর করেছে নদীটির ওপর। এসব সমস্যা সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিকট অতীতেও নৌপুলিশ অভিযান পরিচালনা করত। এখন তা দেখা যায় না। ফলে অবাধে বসানো হচ্ছে জাল, চলছে ইঞ্জিনচালিত নৌকা ও বোট, নদী থেকে তুলে পরিবহন করা হচ্ছে বালি। এ ছাড়া রয়েছে প্রকল্পের নানা উপকরণ। তীরবর্তী এলাকায় আছে ইটভাটা। ভাটাগুলোতে রাতে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় মাটি ও বালি সরবরাহ করা হচ্ছে। এসব নৌকার কারণে নষ্ট হচ্ছে মাছের প্রাকৃতিক পরিবেশ। অন্যদিকে সিডিএর অনন্যা আবাসিক এলাকার ও চট্টগ্রাম মহানগরের দূষিত বর্জ্য বামনশাহী, কুয়াইশ ও খন্দকিয়া খাল হয়ে সরাসরি গিয়ে পড়ছে হালদা নদীতে। এর সঙ্গে আছে নদীর দুই পাড়ের কৃষিজমির কীটনাশক। আছে এই অঞ্চলের শিল্প-বাণিজ্যিক বর্জ্য। এ ছাড়া ফটিকছড়ির ভুজপুরের অপরিকল্পিত রাবার ড্যামের কারণেও দূষিত হচ্ছে হালদার পানি। ডলফিন অন্যান্য মাছের সুস্থতা রক্ষা করে। অথচ অপরিকল্পিত বাঁধ তৈরি, মিঠাপানির প্রবাহ কমে যাওয়া, নির্বিচারে হত্যা, মাছধরার জালে আটকে পড়ে মৃত্যুর কারণে এদের সংখ্যা প্রতিনিয়তই কমছে। ফলে হালদা হারাচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য। অন্যদিকে হালদা নদীতে ২০২০ সালে মাছের ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর