সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

প্রতারণার টাকায় আয়েশি জীবন

আলী আজম

জীবনের তাগিদে ঢাকায় এসে ওষুধ কোম্পানির মার্কেটিং বিভাগে চাকরি নেন মো. কবির হোসেন জোবায়ের। একাধিক ওষুধ কোম্পানি ও কনজিউমার প্রোডাক্টস কোম্পানির মার্কেটিং বিভাগে কাজ করতে করতে নানা কৌশল রপ্ত করে ফেলেন তিনি। এই কৌশল কাজে লাগিয়ে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন পেয়ে বসে বরিশালের কাজীরহাট থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করা কবিরের। প্রতারণার জন্য স্কুল জীবনের এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন প্রতারক চক্র। নিজের ও সহকারীদের বিভিন্ন ভুয়া নাম ব্যবহার করে নিত্যপণ্যের একের পর এক ভুয়া কোম্পানি খোলেন। সেগুলোতে চাকরি দেওয়ার নামে এবং সারা দেশে কোম্পানির ডিলার নিয়োগের কথা বলে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা।

প্রতারণার এই টাকায় নির্মাণ করেন বিলাসবহুল বাড়ি। চক্রের অন্য সদস্যদের নিয়ে কাটানো শুরু করেন আয়েশি জীবন। একটি কোম্পানির নামে টাকা হাতানোর পর পাল্টে ফেলতেন কোম্পানির নাম ও অফিস। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। কবির হোসেন জোবায়ের ওরফে আক্তার হোসেন ওরফে আশরাফুল ওরফে রাসেলসহ চক্রের চার সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গ্রেফতার অন্যরা হলেন- মো. মামুন হোসেন ওরফে বেলাল ওরফে কামরুল, আবু হাসান  ওরফে জামিল হোসেন ও আবদুল্লাহ আল রাজী।  শনিবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে ডিলারশিপ নিয়োগে ভিকটিমদের আবেদনপত্র, চাকরিপ্রত্যাশীদের জীবনবৃত্তান্ত, পরিচয় সংবলিত ভিজিটিং কার্ড, চারটি মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, প্যাকেট সিলিং মেশিন ও বিভিন্ন পণ্যের নমুনা জব্দ করা হয়। ডিবি সূত্র জানায়, কবির তার বিভিন্ন নাম ব্যবহার করে নিত্যপণ্যের ভুয়া কোম্পানি খোলা শুরু করেন। সেই কোম্পানিগুলোতে ডিলার ও এরিয়া ম্যানেজার নিয়োগের জন্য পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রতারণার ফাঁদ পাতেন। প্রথমে তিনি নাবিলা ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড একটি কোম্পানি খুলে ওই কোম্পানির নামের লেবেল দেওয়া বিভিন্ন পণ্য নিয়ে মিরপুরে সুসজ্জিত চটকদার অফিস স্থাপন করেন। সেই অফিসে তার মূল সহযোগী ছিলেন তার স্কুল জীবনের বন্ধু মামুন হোসেন। মামুনের ম্যান পাওয়ার রপ্তানি ব্যবসার অভিজ্ঞতা থাকায় তিনি কবিরকে ডিলার এবং কর্মী নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে সহযোগিতা করে প্রতারণা কার্যক্রমকে আরও কার্যকর করে তোলেন। তারা দুজনই এ প্রতারণা কার্যক্রমে ভুয়া নাম ব্যবহার করেন। নাবিলা ফুড প্রোডাক্টস নামীয় ভুয়া কোম্পানির মাধ্যমে ডিলারশিপ ও কর্মী নিয়োগের কথা বলে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে সেই অফিস বন্ধ করে পালিয়ে যান। পরবর্তীতে তারা নতুন করে তৃষ্ণা ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড নামে আরও একটি ভুয়া কোম্পানি খোলেন। এই কোম্পানিতে তারা জামিলকে মার্কেটিং ম্যানেজার এবং এইচআর অ্যান্ড অ্যাডমিন হিসেবে রাব্বীকে যুক্ত করেন। জামিল ও রাব্বী সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত সাবেক সৈনিক। তারা সেনাবাহিনীর সাবেক সৈনিক পরিচয় দেওয়ার কারণে সহজে ভিকটিমদের বিশ্বাস অর্জন করতে পারেন। নাবিলা ফুড প্রোডাক্টসের কায়দায় এই কোম্পানির মাধ্যমেও তারা লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। এদিকে, এই প্রতারকদের বিরুদ্ধে গত শনিবার রাজধানীর পল্লবী থানায় দায়ের হওয়া প্রতারণা মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, ডিলারশিপ দিতে কবির চক্র তাদের ভুয়া কোম্পানির লেভেল লাগানো তেল, চিনি, আটা, ময়দা, হলুদ ও মরিচসহ ৩০টির বেশি পণ্য দেখিয়ে বিশ্বাস স্থাপন করে। এভাবে ডিলারশিপের চুক্তি অনুযায়ী নোয়াখালী অঞ্চলে ডিলারশিপ দিতে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৫ লাখ, লালমনিরহাটে ডিলারশিপ দিতে চেয়ে দুলাল আহাম্মেদের কাছ থেকে ১০ লাখ ৫ হাজার, মহিনি চন্দ্র রায়কে ঠাকুরগাঁও অঞ্চলের ডিলারশিপের দিতে চেয়ে ২ লাখ ৪০ হাজার, আওয়াল নামে একজনকে রংপুর, সাভার ও পাবনা অঞ্চলের ডিলারশিপের জন্য ৬ লাখ ৫৫ হাজার টাকা হাতিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায়। পরে ভিকটিমরা অফিসে গিয়ে দেখেন, সেখানে ওই নামে কোনো অফিস নেই। এরপর পত্রিকায় তৃষ্ণা ফুড প্রোডাক্টসের বিজ্ঞাপন দেখে প্রতারকদের শনাক্ত করেন তারা। ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম দক্ষিণ বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মো. সাইফুর রহমান আজাদ বলেন, গ্রেফতারকৃতরা একটি সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের সদস্য। তারা ভুয়া নাম-পরিচয় ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের ফাঁদে ফেলতেন। যাচাই-বাছাই না করে কোনো কোম্পানির ডিলারশিপ কিংবা কর্মী নিয়োগের জন্য টাকা না দেওয়ার আহ্বান জানান ডিবির এই কর্মকর্তা।

সর্বশেষ খবর