সোমবার, ১৩ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

গোয়েন্দা কায়দায় ইয়াবা বিক্রি

মাহবুব মমতাজী

গোয়েন্দা কায়দায় ইয়াবা বিক্রি

দেশব্যাপী মাদকবিরোধী নিয়মিত অভিযানেও কমেনি মাদকের বিস্তার। ঢাকাসহ সারা দেশে মাদকের ব্যবহার বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। পুরো সীমান্ত সিল থাকার পরও আগের মতোই দেশে ঢুকছে মাদক। ক্রমেই যেন ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে মাদক পরিস্থিতি। বেশির ভাগ এলাকায় মাদক অনেকটা গোয়েন্দা কায়দায় বিক্রি হয়। কয়েক দফা যাচাইয়ের পর গ্রাহকের হাতে পৌঁছে। এর নেপথ্যে রয়েছে প্রভাবশালী মহলের কিছু ব্যক্তি। তবে মাদকের সহজলভ্যতায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেকে।

২০০০ সালের পর টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আসতে শুরু করে। এরপর এটি খুব দ্রুতই সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তবে দেশে প্রথম ইয়াবার চালান ধরা পড়ে ২০০৩ সালে রাজধানীর গুলশানে। এখন সারা দেশে প্রতিদিনই গড়ে লাখের বেশি ইয়াবা জব্দ হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইয়াবা পাচারের ১৫টি রুট দুর্গম হওয়ায় চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে সারা দেশ থেকে প্রতিদিনই জব্দ হচ্ছে গড়ে প্রায় সোয়া লাখ পিস ইয়াবা। ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অভিযানে জব্দ হওয়া মাদকের পরিসংখ্যান থেকে এমন তথ্য পাওয়া যায়।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, সীমান্ত দিয়ে দেশে যে পরিমাণ ইয়াবা ঢুকছে তার অল্পসংখ্যকই ধরা পড়ছে তাদের অভিযানে। আটক ইয়াবার বেশির ভাগই কক্সবাজার-মিয়ানমার সীমান্ত থেকে আসা। পাচারকারীদের নিত্যনতুন কৌশলের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্র বলছেন, গত ছয় বছরে সারা দেশে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অভিযানে জব্দ হয়েছে ২৫ কোটি ৮৮ লাখ ৯৭ হাজার ৫৭০ ইয়াবা। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ১ লাখ ১৮ হাজার ২১৪ পিস ইয়াবা ধরা পড়েছে। ২০১৭ সালে ৪ কোটি ৭৯ হাজার ৪৪৩, ২০১৮ সালে ৫ কোটি ৩০ লাখ ৪৮ হাজার ৫৪৮, ২০১৯ সালে ৩ কোটি ৪ লাখ ৪৬ হাজার ৩২৮, ২০২০ সালে ৩ কোটি ৬৩ লাখ ৮১ হাজার ১৭, ২০২১ সালে ৫ কোটি ৩০ লাখ ৭৩ হাজার ৬৬৫  এবং গত বছর ৪ কোটি ৫৮ লাখ ৬৮ হাজার ৫৬৯ পিস ইয়াবা জব্দ হয়েছে। ছয় বছরে ইয়াবা জব্দের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৬ লাখ ২৯ হাজার ৭৫১টি, আর আসামি করা হয়েছে ৮ লাখ ১৭ হাজার ৫৩৩ জনকে।

গত বছর মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবসে প্রকাশিত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) প্রতিবেদনে বলা হয়, কক্সবাজার ও বান্দরবান দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা পাচারের ১৫টি রুট দুর্গম হওয়ায় চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। মিয়ানমারের শান ও কোচিন প্রদেশে কারখানা স্থাপন করে ইয়াবা উৎপাদন করা হচ্ছে। এ ১৫টি পয়েন্টের মধ্যে ১০টি কক্সবাজার আর পাঁচটি বান্দরবান সীমান্তে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর তল্লাশি থাকায় সম্প্রতি রুটও বদল করেছেন ইয়াবার কারবারিরা। কৌশল পরিবর্তন করে তারা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ইয়াবা পাচারে বেছে নিয়েছে সাতটি নতুন রুট। এর মধ্যে রয়েছে পাশের মিজোরাম, আসাম ও মণিপুর হয়ে ত্রিপুরার দুটি রুট আর বান্দরবান, কক্সবাজার, বরিশাল, যশোর ও সাতক্ষীরার পাঁচটি রুট। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আজিজুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে বলেন, ইয়াবার চোরাচালান ঠেকাতে আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সবাই তৎপর আছি। আর ইয়াবা চোরাচালান রোধে কক্সবাজারে একটি বিশেষ টাস্কফোর্সও করা হয়েছে। আমাদের তৎপরতার কারণে ইয়াবা যা আসছে তা জব্দ করা হচ্ছে। ডিএনসি, পুলিশ ও র‌্যাবের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেনের সুযোগ নিচ্ছে কারবারিরা। ইয়াবা ট্যাবলেট সহজেই বহনযোগ্য। মূলত কাটআউট পদ্ধতিতে দেশের ভিতরে চলছে এ কারবার। বাহক প্রাথমিক অবস্থায় জানে না কে গ্রহণ করবে। বর্তমানে বাহকের পেটের ভিতর পাকস্থলীতে করে ইয়াবা বহন বেড়েছে। এ ছাড়া পিঁয়াজ, বেগুন, আসবাব, গাছের গুঁড়িসহ বিভিন্ন মালামালের সঙ্গে বহন করা হয় ইয়াবা। আগে থেকে সোর্সের মাধ্যমে তথ্য না পেলে পরিবহনের সময় সাধারণ তল্লাশি চালিয়ে তাদের শনাক্ত করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আবার পেটে ইয়াবা বহনকারীদের গ্রেফতারের পরও পড়তে হচ্ছে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। পেটের মধ্য থেকে ইয়াবা বের করা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। গত বছর আগস্টে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতে অসুস্থ হয়ে একজন মারা যান। পরে ময়নাতদন্তে তার পেটে অর্ধগলিত ইয়াবা পাওয়া যায়। ইয়াবা ট্যাবলেটের অন্যতম খুচরা বাজার রাজধানী। সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে ঢাকাকে ট্রানজিট হিসেবেও ব্যবহার করা হচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর