মঙ্গলবার, ১৪ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

অস্থির সময়ে স্বস্তির বাজেটের লক্ষ্য

থাকছে চাল ডাল তেলসহ খাদ্যপণ্যের দাম কমানোর কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণসহ নির্বাচনী কৌশল, ব্যবসা বিনিয়োগকে অগ্রাধিকারের বিষয়

মানিক মুনতাসির

অস্থির সময়ে স্বস্তির বাজেটের লক্ষ্য

গত বছরের জুনে যখন ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করা হয় তখন করোনা মহামারির রেশ থাকলেও দ্রব্যমূল্য ছিল অনেকটাই সহনীয়। সে সময় দুই কেজি আটার দাম ছিল ৭০-৭৫ টাকা। এখন সেই আটার দাম ১৪০ টাকা। সে সময়ও মোটা চালের দাম ছিল ৪০ টাকা। এখন সেই চাল ৫০-৫৫ টাকা। এসঙ্গে ডিম, মাছ, মাংস, সবজির দামও বেড়েছে। এরই মধ্যে গ্যাস-বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হয়েছে একাধিকবার। ফলে বেড়েছে শিল্প ও কৃষি উৎপাদন খরচ।

এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে খাদ্য, শিল্পসহ প্রায় সব ধরনের বাজার পণ্যে। সরকারের তদারকিও কমেছে। সব মিলিয়ে চরম এক অস্থির সময় পার করছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। এমন অস্থিরতার মধ্যেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জনগণকে স্বস্তির খবর দিতে চায় সরকার। যা আসছে ২০২৩-২৪ বাজেটের মাধ্যমে প্রতিফলিত হবে বলে মনে করেন সরকার সংশ্লিষ্টরা।

অর্থবিভাগের সূত্রগুলো বলছে, এ জন্য করকাঠামোতে এমন কিছু কৌশলগত পরিবর্তন আনা হবে, যাতে ভোগ্যপণ্যের বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। চাল, ডাল, তেলসহ খাদ্যপণ্যের দাম কমানোর কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশনা থাকবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আসছে বাজেটে নির্বাচনী কৌশল, ব্যবসা-বিনিয়োগকে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। সূত্র জানায়, সে অনুযায়ীই বাজেট প্রণয়নের কাজ চলছে। জাতীয় রাজস্ব রোর্ড (এনবিআর) বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে এরই মধ্যে প্রাক-বাজেট আলোচনা শুরু করেছে। এ মাসেই প্রাক-বাজেট শুরু করবে অর্থবিভাগও। কেননা ডিসেম্বরের শেষ দিকে কিংবা আগামী জানুয়ারির শুরুতেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ জন্য আগামী জুনে যে বাজেটটি ঘোষণা করবেন অর্থমন্ত্রী সেটির বেশির ভাগ পরিকল্পনাই থাকবে নির্বাচনমুখী বলে মনে করে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। অব্যাহত দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বৃদ্ধি, লাগামহীন পরিবহন খরচ মানুষের জীবন যাত্রার ব্যয় বাড়িয়েছে অনেক গুণ। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় পাগলা ঘোড়ার মতই ছুটছে। এরই মধ্যে রেকর্ড করেছে মূল্যস্ফীতি। উৎপাদন ও সরবরাহে তেমন কোনো সংকট না থাকলেও সুষ্ঠু বণ্টন ব্যবস্থাপনার অভাবে জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। প্রায় আড়াই বছর ধরে চলা করোনা মহামারির ফলে এমনিতেই দেশের মানুষের আয় কমে গেছে। নতুন করে দারিদ্র্য সীমার নিজে নেমে গেছে বহু মানুষ। এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে জ্বালানি তেলের বিশ্ববাজারে চলছে চরম অস্থিরতা। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির প্রায় সবগুলো সূচকই নেতিবাচক পর্যায়ে রয়েছে। এমন এই অস্থির সময়ে দেশের মানুষকে সামান্য হলেও স্বস্তি দিতে চায় সরকার। আসছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের যে বাজেট প্রস্তুত করা হচ্ছে সেখানে সে চেষ্টাই করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১ জুন জাতীয় সংসদে নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করতে পারেন অর্থমন্ত্রী।

অর্থবিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, বাজেটের অঙ্ক যাই হোক বাজেটে সাধারণ মানুষের জন্য কিছু হলেও সুখবর দিতে চায় সরকার। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা। জনগণের কাঁধে নতুন করে করের বোঝা না চাপানো। যদিও বাজেটের ঘাটতি ও ভর্তুকি কমাতে গ্যাস-বিদ্যুৎ, পানিসহ সব ধরনের জ্বালানি ও পরিষেবার দাম বাড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। এতে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে। কিন্তু আসছে বাজেটে এমন কিছু উদ্যোগ নিতে চায় সরকার- যার ফলে জীবন যাত্রার ব্যয় লাগামহীনভাবে বাড়বে না। জিনিসপত্রের দাম নাগালের মধ্যে রাখার চেষ্টা থাকবে। সব বিষয় মাথায় রেখেই বাজেট প্রণয়নের কাজ করছেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা। অর্থমন্ত্রী এরই মধ্যে বলেছেন, এবারের বাজেট হবে জনকল্যাণের বাজেট। এমন একটি বাজেট দেওয়া হবে যার মাধ্যমে সবাই উপকৃত হবেন।

সূত্র জানায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এটিই হবে বর্তমান সরকারের শেষ বাজেট। এমনকি এই বাজেটের পুরোটা সময় বাস্তবায়নও করতে পারবে না বর্তমান সরকার। কেননা আগামী বছর নতুন সরকার আসবে নির্বাচনের মাধ্যমে। সে হিসাবে অর্থবছরের অর্ধেক বর্তমান সরকার ও পরবর্তী ছয় মাস নতুন সরকার এসে বাস্তবায়ন করবে। সেটাকেও দেখা হচ্ছে গুরুত্ব দিয়ে। এসব ভাবনা মাথায় রেখেই আগামী বাজেটের অর্থ বরাদ্দের খাত সাজানো হচ্ছে। যেসব খাতের সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে সরাসরি ভোটার তুষ্টির বিষয় সম্পৃক্ত; আগামী বাজেটে সেসব খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যেমন বরাদ্দ গত অর্থবছরের তুলনায় বাড়ানোর ঘোষণা আসছে তেমনি সুবিধাভোগীর আওতাও সম্প্রসারিত করা হচ্ছে। বাজেটের আরও কোন কোন খাতে নজর দিলে ভোটারদের আকৃষ্ট করা যাবে- সেদিকেও খেয়াল রাখা হচ্ছে। এ ছাড়া করোনাভাইরাস মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে যে ধাক্কা লেগেছে তা পুনরুদ্ধার কার্যক্রম অব্যাহত রাখতেও নতুন রূপরেখা থাকবে আগামী বাজেটে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আসছে ২০২৩-২৪ বাজেটে মোটা দাগে কতগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে তা হলো- বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, নতুন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কেননা দেশে গত কয়েক বছরের বেকারের সংখ্যা বেড়েছে অনেক বেশি। ভর্তুকির নিরাপদ সংস্থান করতে হবে। বাজেট ঘাটতি কমিয়ে আনতে হবে। এ ছাড়া দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে আনতে হলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। একইভাবে বৈদেশিক মুদ্রার সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে স্থিতিশীল শক্তিশালী রিজার্ভ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এ ছাড়া ক্ষয়িষ্ণু ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা ফেরাতে হলে সরকারকে এ খাতে অবশ্য সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটাও এই নির্বাচনী বাজেটে সরকারের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান।

সর্বশেষ খবর