মঙ্গলবার, ২৮ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

তিতাসের পুরনো লাইনে মৃত্যুফাঁদ

♦ রাজধানীর ৭০ শতাংশ লাইনই অতি ঝুঁকিপূর্ণ ♦ লাইনগুলো ২০ থেকে ৫০ বছরের পুরনো ♦ পাঁচ বছরে ৫৮ জনের প্রাণহানি

জিন্নাতুন নূর

তিতাসের পুরনো লাইনে মৃত্যুফাঁদ

ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকায় তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিসন অ্যান্ড ডিস্ট্র্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের পুরনো গ্যাস লাইন, অবৈধ সংযোগ ও নিম্নমানের পাইপলাইনের কারণে ঘটছে একের পর এক ভয়ংকর দুর্ঘটনা। নগরজুড়ে মাটির নিচ দিয়ে জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জরাজীর্ণ এই লাইন এখন রূপ নিয়েছে মৃত্যুফাঁদে। পুরনো এসব পাইপলাইন ফেটে গ্যাস বেরিয়ে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। এতে বাড়ছে লাশের সারি। আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করছেন বহু মানুষ। বিস্ফোরক অধিদফতরের তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরে তিতাসের আওতাধীন এলাকায় গ্যাস পাইপলাইনজনিত ১৪টি দুর্ঘটনায় ৫৮ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, রাজধানীতে তিতাসের ৭ হাজার কিলোমিটার পাইপলাইন আছে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশই অতি ঝুঁকিপূর্ণ। আর তিতাসের পাইপলাইনগুলো ২০ বছর থেকে শুরু করে ৫০ বছরের অধিক পুরনো। অর্থাৎ তিতাসের স্থাপিত লাইনের অর্ধেকের মেয়াদ পেরিয়েছে বহু আগেই। তিতাসের তথ্য মতে, ২০২০ সালে মোট অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটে ২৮১টি এবং ২০২১ সালে ৩১১টি। এ ছাড়া এই দুই বছরে গ্যাস লিকেজের ঘটনা ঘটে ৭ হাজার ৩৫টি এবং ৪ হাজার ৮৯১টি। ২০২১-২২ অর্থবছরে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা এবং কেরানীগঞ্জ এলাকায় মোট ১৬৮২ দশমিক ৪ কিলোমিটার পাইপলাইন সার্ভে করে প্রাথমিকভাবে ৯ হাজার ৯২৬টি গ্যাসের (মিথেন) উৎস শনাক্ত হয়। যার মধ্যে ১ হাজার ৭১২টি গ্যাস উৎস লোকালাইজ করা হয় এবং চূড়ান্তভাবে ৪৫৯টি লিকেজ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যা ৯৮৫টি ক্ল্যাম্প স্থাপনের মাধ্যমে মেরামত করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজধানী ঢাকায় এখন যে গ্যাস পাইপলাইন নেটওয়ার্ক আছে তা ‘টিকিং টাইম বোম’ এর মতো। যে কোনো মুহূর্তে এই বোমা বিস্ফোরিত হয়ে ঘটতে পারে বড় দুর্ঘটনা। তারা আরও বলেন, ঢাকায় যে লাইন দিয়ে ৫০ জন গ্রাহকের লাইনে গ্যাস আসার কথা সে লাইন দিয়ে ৫০০ জন গ্রাহককে গ্যাস দেওয়া হয়। ফলে সেই লাইনে চাপ বেড়ে যাচ্ছে। আবার পাইপলাইনগুলো দুর্বল হওয়ার কারণে এর প্রেসার নেওয়ার ক্ষমতাও দিন দিন কমে যাচ্ছে। এই পাইপ লাইনগুলোতে জং ধরছে এবং যে লাইনগুলো খোঁড়াখুঁড়ির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা থেকেও গ্যাস লিক হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। তারা আরও বলেন, তিতাস কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবে রাজধানী ও তার আশপাশের গ্যাস বিতরণ লাইনগুলো হয়ে উঠেছে মৃত্যুফাঁদ। আবার গ্রাহকদের অসচেতনতাও দুর্ঘটনার পেছনে অন্যতম কারণ। আবাসিকে গ্যাসের ফিটিংস অদক্ষ মেকানিক দিয়ে লাগানো, রান্নার পর চুলা না নেভানো, অবৈধ লাইনের ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবহারেও দুর্ঘটনা ঘটছে। এ জন্য মাসে অন্তত একবার হলেও সবাইকে ঘরে গ্যাস লিক হচ্ছে কি না তা নিরাপত্তার স্বার্থে তদারকি করা প্রয়োজন।

জানা যায়, সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে নতুন পাইপলাইন স্থাপনের মাধ্যমে গ্যাস নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করা হয়নি। তবে বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের স্বল্পচাপ সমস্যা নিরসন এবং ক্ষতিগ্রস্ত পাইপলাইন প্রতিস্থাপনের জন্য ৮২ দশমিক ৩১ কি.মি. লিংক লাইন, পাইপলাইন প্রতিস্থাপন কাজ করা হয়েছে। ২০২১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জে একটি মসজিদের নিচে গ্যাস পাইপলাইনের ছিদ্র থেকে গ্যাস জমে বিস্ফোরণের পর অগ্নিকাণ্ডে ৩৪ জন মুসল্লি মারা যান। এরপর গ্যাস বিতরণ লাইনে ১ হাজার ৬২২টি ছিদ্র শনাক্ত করার কথা জানায় তিতাস কর্তৃপক্ষ। পরে সেসব ছিদ্র মেরামত করা হয়। গত অর্থবছরে তিতাসের জরুরি নিয়ন্ত্রণ কক্ষে অভিযোগ আসে ৬ হাজার ৮৬২টি। এর মধ্যে গ্যাসের পাইপলাইনে ছিদ্রের ঘটনা ৪ হাজার ৮৯১টি। আর অগ্নিদুর্ঘটনার ঘটনা ঘটে ৩১১টি। ২০২১ সালে মগবাজারে বিস্ফোরণের ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিতাসের বিচ্ছিন্ন করা সংযোগের পাইপলাইন থেকে গ্যাস জমে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়াও সম্প্রতি সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় ও সিদ্দিকবাজারের ভবনে বিস্ফোরণের কারণও মগবাজারের মতই বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও তিতাস কর্তৃপক্ষ বিষয়টি অস্বীকার করেছে। নিয়ম অনুযায়ী কোনো ভবনের বেজমেন্টে গ্যাস-সংযোগ থাকার সুযোগ নেই। কিন্তু সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরিত ভবনের বেজমেন্টে তিতাসের একটি পরিত্যক্ত সংযোগ খুঁজে পেয়েছে সরকারের দুটি সংস্থা। তিতাস গত দুই বছর ধরে অবৈধ সংযোগ উচ্ছেদে অভিযান চালাচ্ছে। গত অর্থবছরে ২৮৮টি অভিযান চালানো হয়। এতে ৩৪০ কি.মি. অবৈধ গ্যাসলাইন উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু এরপরও থেমে নেই অবৈধ সংযোগ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাইপলাইন ও সংযোগের কোনো মান যাচাই করা হয় না। এতে ঘটছে বড় দুর্ঘটনা। তিতাসের পাইপলাইন ও সংযোগের ভৌগোলিক তথ্যব্যবস্থা করার জন্য জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) পরামর্শ করা দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্বপ্রাপ্তদের বলে আসছেন। জাইকা পাইপলাইন সুরক্ষায় আলাদা বিভাগ করার কথাও বলছে। পুরো পাইপলাইনের এই নকশা তৈরি হলে সড়ক ও জনপথ বা অন্য সংস্থার কাজ করার ক্ষেত্রে সুবিধা হবে। আবার পাইপলাইনের অবস্থান জানা না থাকায় বিভিন্ন সংস্থা কাজ করতে গিয়ে প্রায়ই তিতাসের পাইপলাইনে ছিদ্র তৈরি করে। উন্নত দেশে গ্যাস পাইপলাইনে স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ থাকে। একে সুপারভাইজরি কন্ট্রোল অ্যান্ড ডেটা অ্যাকুইজিশন সিস্টেম বলে, যা স্ক্যাডা সিস্টেম নামেও পরিচিত। এতে পাইপলাইনে কোথাও ছিদ্র হলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে শনাক্ত করা যায়। অনেকদিন ধরে দেশে এই প্রযুক্তি আনার কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত তা শুরু হয়নি। তবে আশার কথা হলো, তিতাসের নতুন প্রকল্পের আওতায় ঢাকায় তিতাসের ১৩৯টি এলাকার মধ্যে ৬০টি এলাকা ও নারায়ণগঞ্জের ৩০টি এলাকায় নতুন পাইপলাইন বসানোর প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এতে মোট ২ হাজার ৬০০ কি.মি. পাইপলাইনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছিদ্র শনাক্ত করা যাবে। তিতাসের কর্মকর্তারা জানান, আবরণ ছাড়া মাটির নিচে পাইপ স্থাপন করলে তাতে লিকেজ হতে পারে। তিতাস যে পাইপ ব্যবহার করছে তা চীনের তৈরি এবং এর মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। আবার বেশিরভাগ পাইপ মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় এর লিকেজ হচ্ছে। আবার বিভিন্ন সেবা সংস্থার খোঁড়াখুঁড়ির কারণে তিতাসের লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঢাকা শহরে যে গ্যাস পাইপ লাইন নেটওয়ার্ক আছে তা একটি টিকিং টাইম বোম। এখানে কত জায়গায় যে লিকেজ আছে তা কেউ জানে না। আমাদের এখানে যখন একটি ঘটনা ঘটে তখন সবাই হুমড়ি খেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ লাইন মেরামত করে। এ ধরনের অসংখ্য অবৈধ লাইন আছে যে স্থানে সেখানে ছোট-বড় লিকেজ হচ্ছে। এজন্য এ থেকে সৃষ্ট দুর্ঘটনা রোধে সরকার ও দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাকে একটি মাস্টারপ্ল্যান গ্রহণ করতে হবে। এর আওতায় পুরো পাইপ লাইনটিকে সার্ভে করে অবৈধ সংযোগের মতো বিপজ্জনক পয়েন্ট চিহ্নিত করে তা উচ্ছেদ করা এবং পুরনো লাইনগুলোও একইসঙ্গে পরিবর্তন করতে হবে। এমনটি করা না গেলে কেউই বিপদমুক্ত হতে পারবে না।

সর্বশেষ খবর