বুধবার, ৫ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা
প্রাক-বাজেট সংবাদ সম্মেলন

জুয়েলারি শিল্পের উন্নয়নে বাজুস প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চায়

নিজস্ব প্রতিবেদক

জুয়েলারি শিল্পের উন্নয়নে বাজুস প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চায়

বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) কার্যালয়ে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাজুস প্রেসিডেন্ট সায়েম সোবহান আনভীর, সহসভাপতি আনোয়ার হোসেন। জুয়েলারি শিল্পের উন্নয়নে সংগঠনের পক্ষ থেকে একগুচ্ছ প্রস্তাব তুলে ধরেন নেতারা। তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন -বাংলাদেশ প্রতিদিন

জুয়েলারি শিল্পের উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ চেয়েছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস)। একই সঙ্গে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে জুয়েলারি পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে আরোপিত ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ, অপরিশোধিত আকরিক সোনায় আরোপিত সিডি ৫ শতাংশের পরিবর্তে ১ শতাংশ ও আংশিক পরিশোধিত সোনার সিডি ১০ শতাংশের পরিবর্তে আইআরসিধারী এবং ভ্যাট কমপ্লায়েন্ট শিল্পের শুল্কহার ৫ শতাংশ করার দাবি জানিয়েছে বাজুস। দেশের স্বর্ণশিল্প বিকাশে গোল্ড রিফাইনারি উদ্যোক্তাদের জন্য ১০ বছরের কর অবকাশ সুবিধা দেওয়ারও প্রস্তাব করেছে বাজুস।

গতকাল রাজধানীর বসুন্ধরা সিটিতে বাজুস কার্যালয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট উপলক্ষে আয়োজিত প্রাক-বাজেট সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাজুস প্রেসিডেন্ট ও বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীর, সংগঠনের সহসভাপতি মো. রিপনুল হাসান, সহসম্পাদক সমিত ঘোষ অপু, স্ট্যান্ডিং কমিটি অন ট্যারিফ অ্যান্ড ট্যাক্সেশনের সদস্যসচিব পবন কুমার আগরওয়াল। বাজুসের উপদেষ্টা রুহুল আমিন রাসেলের সঞ্চালনায় বাজুসের সহসভাপতি আনোয়ার হোসেন লিখিত বক্তব্যে বলেন, বাজুস মনে করছে আগামী দিনে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জাগরণ তুলবে জুয়েলারি শিল্প। বর্তমানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জুয়েলারি শিল্পে প্রায় ৪৪ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। আগামীতে এ শিল্পে ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সম্ভব। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে জুয়েলারি শিল্পে ভ্যালু অ্যাডিশন করে সোনার অলংকার রপ্তানি সম্ভব। দুবাই যেমন সোনার ব্যবসার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, তেমনি বাংলাদেশেরও এ সম্ভাবনা রয়েছে। এটি কাজে লাগাতে জুয়েলারি শিল্পে করমুক্ত সুবিধা চাই। জুয়েলারি শিল্পের বিকাশে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাই।

আনোয়ার হোসেন বলেন, বর্তমানে চরম সংকটে দিশাহারা জুয়েলারি শিল্পের জন্য প্রয়োজন সরকারের নীতিসহায়তা। অপার সম্ভাবনা থাকার পরও সুষ্ঠু রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও নীতিসহায়তার অভাবে জুয়েলারি শিল্প এখন হুমকির মুখে। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের ২০২২ সালের প্রতিবেদন মোতাবেক বিশ্ববাজারে সোনার চাহিদা ছিল ৪ হাজার ৭৪০ টন। এর মধ্যে সোনার অলংকারের চাহিদা ২ হাজার ১৮৯ দশমিক ৮ টন। সরকারের সর্বশেষ সংশোধিত নীতিমালা অনুযায়ী বাংলাদেশের সোনার বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৪০ টন। তবে প্রকৃত চাহিদা নিরূপণে সরকারের সমীক্ষা প্রয়োজন। বৈধভাবে সোনার চাহিদা পূরণ করার ক্ষেত্রে বড় বাধা কাঁচামালের উচ্চ মূল্য, অতিরিক্ত উৎপাদন ব্যয়, শিল্পসংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতির উচ্চ আমদানি শুল্ক। বর্তমানে জুয়েলারি শিল্পের প্রায় সব ধরনের পণ্য ও যন্ত্রপাতির আমদানি শুল্ক ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ; যা স্থানীয় অন্যান্য শিল্পে আরোপিত শুল্কের চেয়ে অনেক বেশি। এতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পাশাপাশি ৫ শতাংশ হারে উচ্চ ভ্যাট হার ও অতিরিক্ত উৎপাদন খরচের কারণে ভোক্তা পর্যায়ে আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে দামের পার্থক্য হচ্ছে। এতে ক্রেতা হারাচ্ছেন জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ছোট ছোট জুয়েলারি ব্যবসায়ী। এমন সংকটেও আমরা সম্ভাবনার কথা বলছি। আনোয়ার হোসেন আরও বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই প্রথম বেসরকারিভাবে সোনা পরিশোধনাগার স্থাপিত হয়েছে। বিশ্ববাজারে আর কিছুদিন পর রপ্তানি হবে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ লেখা সোনার বার ও অলংকার। কিন্তু এ পরিশোধনাগার স্থাপনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির আমদানি শুল্ক অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। ফলে প্রাথমিক পর্যায়েই উৎপাদন খরচ অনেক বেশি। এ নেতিবাচক প্রভাবের দায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নীতিনির্ধারকদের ওপর অনেকখানি বর্তায়। অবাস্তব নীতি প্রণয়ন, শুল্ক নির্ধারণে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের গোঁড়ামি, ভ্যাট ও আয়কর কর্মকর্তা কর্তৃক ব্যবসায়ীদের হয়রানি এবং আমদানির ক্ষেত্রে কাস্টমস সদস্যদের ক্ষমতার অপব্যবহার এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের ভোগান্তি ও আতঙ্কের প্রধান কারণ। এতে সরকার প্রত্যাশিত রাজস্ব থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। বাজুস মনে করে, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশকে প্রতিযোগিতায় সক্ষম করতে জুয়েলারি খাতে আরোপিত শুল্ককর ও ভ্যাটহার কমাতে এবং আর্থিক প্রণোদনা নিশ্চিত করতে হবে। এতে যেমন সরকারের বৈদেশিক আয় আসবে, তেমনি বাড়বে রাজস্ব। বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের আরেকটি খাত তৈরি হবে।

এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে ১২টি প্রস্তাব উপস্থাপন করছে বাজুস।

প্রস্তাবগুলো হলো : বর্তমানে জুয়েলারি ব্যবসার ক্ষেত্রে সোনা, সোনার অলংকার, রুপা বা রুপার অলংকার বিক্রির ক্ষেত্রে আরোপিত ভ্যাটহার ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করা। ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) যত দ্রুত সম্ভব নিবন্ধনকৃত সব জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানে বিতরণ করা। সব জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানে ইএফডি না বসিয়ে কাউকে হয়রানি করা যাবে না। বর্তমানে অপরিশোধিত আকরিক স্বর্ণের ক্ষেত্রে আরোপিত সিডি ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে আমদানি শুল্ক শর্ত সাপেক্ষে ১ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে বাজুস। আংশিক পরিশোধিত স্বর্ণের ক্ষেত্রে সিডি ১০ শতাংশের পরিবর্তে আইআরসিধারী এবং ভ্যাট কমপ্লায়েন্ট শিল্পের জন্য শুল্কহার ৫ শতাংশ করা। হীরাশিল্প বিকাশে কাটিং ও প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রয়োজনীয় আমদানিকৃত রাফ ডায়মন্ডে সহনশীল শুল্কহার নির্ধারণ। বিশেষ করে সিডি ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছে বাজুস। বৈধ পথে মসৃণ হীরা আমদানি ও রপ্তানিতে উৎসাহী করার জন্য সব ধরনের শুল্ককর সহনীয় পর্যায়ে নির্ধারণ করা হলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের আরেকটি খাত যুক্ত হবে বলে মনে করে বাজুস। আয়কর আইনে ৪৬-(বিধি) (২) ধারার অধীনে গোল্ড রিফাইনারি বা সোনা পরিশোধনাগার শিল্পে ১০ বছরের জন্য কর অবকাশ বা ট্যাক্স হলিডে প্রদানের প্রস্তাব করেছে বাজুস। আমদানিকৃত কাঁচামাল ও মেশিনারিজের ক্ষেত্রে সকল প্রকার শুল্ককর অব্যাহতি প্রদানসহ ১০ বছরের জন্য কর অবকাশ বা ট্যাক্স হলিডে প্রদানের প্রস্তাব। বৈধভাবে স্বর্ণবার, স্বর্ণালংকার, স্বর্ণের কয়েন রপ্তানি উৎসাহিত করতে কমপক্ষে ২০ শতাংশ মূল্য সংযোজন করার শর্তে রপ্তানিকারকদের মোট মূল্য সংযোজনের ৫০ শতাংশ হারে আর্থিক প্রণোদনা চেয়েছে বাজুস। স্বর্ণশিল্পের বিকাশে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে এইচ এস কোডভিত্তিক ‘অস্বাভাবিক শুল্কহার’ কমিয়ে পাশের দেশগুলোর সঙ্গে শুল্কহার সমন্বয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। চোরাচালান প্রতিরোধ করতে গিয়ে কাস্টমস কর্তৃপক্ষসহ সব আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উদ্ধারকৃত সোনার মোট পরিমাণের ২৫ শতাংশ সংস্থাগুলোর সদস্যদের পুরস্কার হিসেবে প্রদানের প্রস্তাব করেছে বাজুস। ব্যাগেজ রুলের আওতায় স্বর্ণবার ও অলংকার আনার সুবিধা অপব্যবহারের কারণে ডলার সংকট, চোরাচালান ও মানি লন্ডারিংয়ে কী প্রভাব পড়ছে, তা নিরূপণে বাজুসকে যুক্ত করে যৌথ সমীক্ষা পরিচালনা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর