বুধবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

ঝুঁকি বাড়াচ্ছে বজ্রপাত

প্রতি বছর ১৫০-২০০ মানুষের মৃত্যৃ, বেশি ঝুঁকিতে কৃষক ও জেলে

জিন্নাতুন নূর

প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে বজ্রপাতের কারণে বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। এমনকি বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যার বিচারেও সারা বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর বজ্রপাতে ১৫০ থেকে ২০০ জন মানুষ মারা যায় আর এর বেশির ভাগই কৃষক। ধান কাটার মৌসুম হওয়ায় এখন দেশের বেশ কয়েকটি এলাকার কৃষকদের বজ্রপাতে মৃত্যুঝুঁকি বেশি। এর মধ্যে ২৩ এপ্রিল বেশ কয়েকজন কৃষকের এ দুর্যোগে মৃত্যুও হয়েছে। এ ছাড়া বজ্রপাতে জেলেদের মৃত্যুঝুঁকিও রয়েছে।

আবহাওয়াবিদদের মতে, বাংলাদেশে উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতপ্রবণ। আর বজ্রপাতে হতাহতের ঘটনা বেশি ঘটে হাওর অঞ্চলে। কারণ এসব অঞ্চলে জলীয় বাষ্প বেশি থাকে। তাই নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, টাঙ্গাইল, জামালপুর ও ময়মনসিংহকে বজ্রপাতের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন আবহাওয়াবিদরা। দেশের সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট ও নেত্রকোনায় বজ্রপাতে ২৩ এপ্রিল ১০ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে সুনামগঞ্জে ছয়জন, মৌলভীবাজারে দুজন, সিলেটে একজন ও নেত্রকোনায় একজন মারা যান। আর মৃতদের অধিকাংশই কৃষক। পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে, হাওরে এখন বোরো ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ চলছে। এ কারণে কৃষকরা বৃষ্টির আগেই ফসল তুলতে ধান কাটা ও মাড়াই শুরু করেছেন। এই কৃষকরা নিজ নিজ হাওর এলাকায় ধান কাটার সময় কিংবা গরু চরাতে গিয়ে বজ্রপাতে ঘটনাস্থলেই মারা যান। সাধারণত দেশে বর্ষা এবং বর্ষা মৌসুমের আগে-পরে বজ্রপাত বেশি হয়। কিন্তু বদলে যাওয়া আবহাওয়ার কারণে এখন এই সময়ের বাইরেও বজ্রপাতের ঘটনা ঘটছে। এপ্রিল থেকে মে মাসে গ্রামাঞ্চলেও কৃষকরা ধান কাটায় ব্যস্ত থাকেন। এর ফলে তাদের বজ্রপাতে দুর্ঘটনায় পড়তে বেশি দেখা যায়। আবার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেও বাংলাদেশ বজ্রপাতের ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর থেকে উষ্ণ ও আর্দ্র বাতাস আসে এবং উত্তরের হিমালয় থেকে আসে ঠান্ডা বাতাস। এই দুই বাতাসের সংমিশ্রণে বজ্রমেঘ তৈরি হয় এবং এসব মেঘের সঙ্গে মেঘের ঘর্ষণে বজ্রপাত হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং বেসরকারি সংগঠন ‘ডিজাস্টার ফোরাম’-এর তথ্যে, ২০১১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১২ বছরে বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছে ৩ হাজার ১৬২ জনের। অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে বজ্রপাতের ঘটনার ওপর গবেষণা চালিয়ে জানায় যে, দেশে প্রতি বছর গড়ে ৮৪ লাখ বজ্রপাত হয়, যার ৭০ শতাংশই হয় এপ্রিল থেকে জুন মাসে।

বিশেষজ্ঞরা জানান, বাতাসে সিসার পরিমাণ বৃদ্ধি, অতিরিক্ত তাপমাত্রা, মোবাইলের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার এবং এর রেডিয়েশন, গ্রামে মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধি, উঁচু গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া এবং জলাভূমি ভরাটের কারণে বজ্রপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বজ্রপাত আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গ্রামাঞ্চলে খোলা স্থানে বজ্রনিরোধক স্থাপনা ও গাছের অভাবে প্রাণহানির ঘটনা বেশি ঘটছে। সাধারণত গ্রামে বড় বড় গাছ বজ্র-প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। কিন্তু বসতবাড়ি নির্মাণ ও কৃষিকাজের জন্য গাছ কেটে ফেলায় বজ্রপাতে প্রাণহানি আগের চেয়ে বেশি ঘটছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক, জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. এ কে এম সাইফুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কয়েক বছর ধরেই বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষ এখন খোলা মাঠে অনেক বেশি কৃষিকাজে জড়িত। আবার আগের তুলনায় মৎস্য চাষও বেশি হচ্ছে। এই দুই পেশায় জড়িতরা খোলা স্থানে থাকেন। এ জন্য বজ্রপাতে এদের ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকিও বেশি। ক্ষয়ক্ষতি কমাতে একটি বছরে এপ্রিলের শুরু থেকেই এ বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালানো দরকার। এ বিষয়গুলো পাঠ্যবইয়ে রাখতে হবে। হাওর এলাকাগুলোতে বজ্রপাত থেকে রক্ষার জন্য আশ্রয় কেন্দ্র তৈরি করা যেতে পারে। একই সঙ্গে বজ্রপাতে চিকিৎসাব্যবস্থা সম্পর্কে সাধারণ মানুষ ততটা জানেন না। এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। বজ্রপাতের শিকার ব্যক্তিদের সরকারি অর্থ সহায়তার পরিমাণ খুব কম। এটি বৃদ্ধি করা উচিত।

সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক রাশিম মোল্লা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকারের প্রকল্পগুলোর মধ্যে যদি বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপন করা যায় তাহলে কিছুটা উপকার হবে। কিন্তু শুধু ছাউনি বানিয়ে কোনো লাভ হবে না। দেশে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি কৃষকরা মারা যাচ্ছেন। সাধারণত কৃষকরা গরমে কৃষিকাজ করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন না। তারা বৃষ্টির সময় কাজ করতে আগ্রহী। বৃষ্টি পড়া শুরু করলে কৃষকদের অনেকে গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ান। কিন্তু এতে প্রাণহানির ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। এ জন্য দেশের হাওরাঞ্চলে কৃষকদের জন্য বজ্রপাত-নিরোধক দণ্ড স্থাপন করা জরুরি। আমরা দেশীয় প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে এই স্থাপনা তৈরি করতে পারি।’

বজ্রপাত থেকে বাঁচতে : বিশেষজ্ঞরা জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মেঘের ধরনেও পরিবর্তন আসছে। যখনই মাথার ওপর গভীর কালো মেঘ দেখা যাবে, তখনই বুঝতে হবে যে এখানে বজ্রপাতের আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে হবে। আর খোলা জায়গায় কোথাও আশ্রয় না থাকলে নিজেকে গুটিয়ে বসতে হবে। একইভাবে হাওর বা নদীতে থাকলেও গুটিয়ে বসতে হবে। মাঠে কাজ করার সময় বজ্রপাতে কৃষকদের অনেকেই মৃত্যুবরণ করেন। অনেকেই বুঝতে পারেন না যে বজ্রপাতের সময় কী করবেন। এ জন্য এ বিষয়ে যত বেশি প্রচার-প্রচারণা চালানো হবে ততই ক্ষতির পরিমাণ কমবে। বজ্রবৃষ্টি শুরু হলে তা ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এই সময়ে সংশ্লিষ্টরা মানুষকে ঘরে অবস্থান করতে বলেছেন। অতি জরুরি প্রয়োজনে রাবারের জুতা পরে বাইরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। যত দ্রুত সম্ভব দালান বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে বলেছেন। টিনের চালা এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। উঁচু গাছপালা ও বৈদ্যুতিক খুঁটি ও তার, ধাতব খুঁটি, মোবাইল টাওয়ার থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। এ ছাড়া তারা বজ্রপাতের সময় মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, টিভি ও ফ্রিজ ব্যবহার থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। বজ্রপাতের সময় শিশুদের খোলা মাঠে খেলাধুলা থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রতিটি ভবনে বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপন নিশ্চিত করতে হবে।

সরকারি উদ্যোগ : বজ্রপাত থেকে মানুষকে সুরক্ষা দিতে সরকার বেশ কিছু প্রকল্প গ্রহণ করেছে। বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকাতে গ্রহণ করা হয়েছে ‘তালগাছ প্রকল্প’, যা কার্যত ফলপ্রসূ হয়নি। সম্প্রতি বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর, মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার সহযোগিতায় বজ্রপাত সম্পর্কে আগাম তথ্য পেতে ‘হাই ইমপ্যাক্ট ওয়েদার অ্যাসেসমেন্ট’ নামে একটি প্রযুক্তি চালু করেছে। এর মাধ্যমে ৫৪ ঘণ্টা আগেই বজ্রপাত সম্পর্কে আগাম তথ্য পাওয়া যাবে বলে জানা যায়। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষক ও জেলেদের কাছে এ ধরনের প্রযুক্তি সহজলভ্য না হওয়ায় এটি খুব বেশি কাজে লাগবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, বজ্রপাত থেকে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সরকার ‘হাওর রিস্ক ম্যানেজমেন্ট’ নামে নতুন একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। ঝুঁকি বেশি থাকার কারণে হাওর এলাকা ঘিরেই সরকার প্রথম প্রকল্প নিয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও ভৈরবে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। এসব এলাকায় কিছু স্থাপনা গড়ে তোলা হবে। সেখানে কিছু বজ্রপাত প্রতিরোধক দণ্ড স্থাপন করা হবে। আর দ্বিতীয় পর্যায়ে বরেন্দ্র অঞ্চলসহ যেখানে মাঠের পরিমাণ বেশি এবং আশ্রয় নেওয়ার স্থান নেই সেসব এলাকায় আরও কিছু প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর