বুধবার, ১৭ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা
বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস আজ

মরণব্যাধি উচ্চ রক্তচাপ

জয়শ্রী ভাদুড়ী

মরণব্যাধি উচ্চ রক্তচাপ

দেশে ৩ কোটির বেশি মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। প্রতি পাঁচজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে একজন এ রোগের শিকার। আক্রান্তের ৫৯ শতাংশ জানেনই না তারা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। আক্রান্ত জানলেও অনেকেই নিয়মিত ওষুধ সেবন করেন না। অবহেলায় উচ্চ রক্তাচাপ ডেকে আনছে স্ট্রোক, কিডনি, হৃদরোগের মতো নানা ব্যাধি।

এ পরিস্থিতিতে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘সঠিকভাবে রক্তচাপ মাপুন, নিয়ন্ত্রণে রাখুন এবং দীর্ঘজীবী হোন’। উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের জন্য কমিউনিটি ক্লিনিকসহ সব সরকারি হাসপাতালে পাঁচটি ড্রাগ বিনামূল্যে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তবে এর দায়িত্বে থাকা ওষুধ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান (এসেনশিয়াল ড্রাগস) সময়মতো চাহিদা অনুযায়ী ওষুধ সরবরাহ করতে পারছে না। ওষুধ সরবরাহ নিয়মিত না থাকায় ফিরে যাচ্ছেন রোগীরা। তাই যে লক্ষ্যে এ উদ্যোগ, তা মুখ থুবড়ে পড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (অসংক্রামক রোগ) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ‘এখন ওষুধের চাহিদা অনেক বেশি। আগে তো চাহিদা জানা ছিল না। আমরা চাহিদা তৈরি করেছি। তবে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ নিয়মিত সেবন না করলে সমস্যা। আমাদের মূল উদ্দেশ্য রোগীর ওষুধ সেবন যেন অনিয়মিত না হয় কিন্তু তবু হচ্ছে। অপারেশনাল প্ল্যান পাস হতে তিন থেকে চার মাস লেগে যায়, তখন ওষুধ সরবরাহে সমস্যা হয়। এ ছাড়া এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের গাড়ি মাত্র ছয়টি। সব জায়গায় পৌঁছাতে সময় লাগে। তিনি আরও বলেন, অপারেশনাল প্ল্যান থেকে ওষুধ কিনে এ কর্মসূচি চালানো কঠিন। একটা স্থায়ী ব্যবস্থা করতে হবে। রাজস্ব খাত থেকে সরবরাহ নেওয়ার চেষ্টা করছি আমরা।’ হার্ট ফাউন্ডেশনের হাইপারটেনশন কন্ট্রোল ইনেশিয়েটিভ প্রোগ্রামের পরিচালক ডা. মাহফুজুর রহমান ভূঁইয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে দেশে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। এর প্রায় ৬০ শতাংশই তাদের এ রোগ আছে সেটাই জানেন না। যারা জানেন তাদেরও অনেকেই চিকিৎসা নেন না। চিকিৎসা নিচ্ছেন এমন মানুষের ৭৫ শতাংশ নিয়মিত ওষুধ সেবন করেন না। তিনি আরও বলেন, ‘এ পর্যন্ত প্রায় দেড় লাখ মানুষ হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের উচ্চ রক্তচাপ প্রকল্পের অধীনের স্বাস্থ্যসেবা নিয়েছেন। বর্তমানে ৫৪টি উপজেলায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের এনসিডি কর্নারে আমাদের এ প্রকল্প চলছে। এ প্রকল্পে সফলতা পাওয়ায় আগামীতে দেশের ১৮২ উপজেলায় এটি সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের এনসিডি কর্নারের সহায়তায় এ প্রকল্পের নিবন্ধনকৃত রোগীদের বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ করা হয়। তবে এসেনশিয়াল ড্রাগস সময়মতো চাহিদা অনুযায়ী ওষুধ সরবরাহ করতে পারছে না। এতে ব্যাহত হচ্ছে সরকারের এ উদ্যোগ।’ বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপে (২০১৭-১৮) দেখা গেছে, দেশে ১৮ বছরের বেশি বয়সী ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। উচ্চ রক্তচাপ পুরুষের চেয়ে নারীর বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, দেশে ১৮ বছরের বেশি জনসংখ্যা ১১ কোটি ১৮ লাখ ৯৬ হাজার। সে হিসেবে ৩ কোটির বেশি মানুষ এই দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত। এ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, অনেকে রোগ আছে জেনেও চিকিৎসা নিচ্ছেন না। আবার চিকিৎসা নিয়েও অনেকে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছেন না। ওষুধের দাম, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, ওষুধ না পাওয়ার কারণে হয়তো কেউ কেউ মাঝপথে চিকিৎসা বন্ধ করছেন। আবার এমনও হতে পারে যে অনেকে জানেন না ওষুধ দীর্ঘকাল খেয়ে যেতে হবে। দেশে কিডনি রোগ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ বৃদ্ধিকে মনে করা হয়। ২০১৭ সালের বাংলাদেশ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র জরিপে দেখা যায়, ৩৯ শতাংশ কমিউনিটি ক্লিনিকে এ সেবা পাওয়া যায় না। ইউনিয়ন পর্যায়ে সেবা কেন্দ্রে এ হার ৩৬ শতাংশ। এনজিওদের ৩৭ শতাংশ ক্লিনিকে রক্তচাপ মাপা হয় না। এ পরিস্থিতি উচ্চস্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিকেও দেখা যায়। ৫৭ শতাংশ উপজেলা হাসপাতালে ও ৪৩ শতাংশ জেলা হাসপাতালে রক্তচাপ মাপা হয়। অর্ধেক সরকারি মাতৃ ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে এ ব্যবস্থা নেই। স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র জরিপকালে ব্যক্তিমালিকানাধীন ৫২ শতাংশ হাসপাতাল ও ক্লিনিকে এ সেবা দেখা যায়নি। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোয় উচ্চ রক্তচাপের ওষুধের প্রাপ্যতা এবং এজন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। এ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে গতকাল রাজধানীর বিএমএ ভবনে অ্যাডভোকেসি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) ‘বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপ পরিস্থিতি ও করণীয়’ শীর্ষক এক আলোচনা সভার আয়োজন করে। সভায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের কমিউনিটি বেইজড হেলথকেয়ার (সিবিএইচসি)-এর লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. কাইয়ুম তালুকদার বলেন, ‘কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের ওষুধ দেওয়ার ব্যাপারে একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। আশা করি এটি দ্রুত পাস হবে।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামান বলেন, উচ্চ রক্তচাপ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যে গাইডলাইন রয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। সম্মিলিতভাবে কাজ করলে উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ মোকাবিলা করা সম্ভব।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর