শনিবার, ১০ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

ইউটিউব চ্যানেলের নামে সারা দেশে অবৈধ কারবার

চলছে প্রতারণা ব্ল্যাকমেল

নিজস্ব প্রতিবেদক

ইউটিউব চ্যানেলের নামে সারা দেশে চলছে ‘নিউজ ব্যবসা’। আর এ নিউজ ব্যবসার আড়ালে প্রতারণা, ব্ল্যাকমেল থেকে শুরু করে অবৈধ বাণিজ্য চলছে দেদার। মাঝে-মধ্যে এসব অবৈধ ইউটিউব চ্যানেলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও কিছুদিন পর আবারও স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। পারিবারিক কলহ, সামাজিক, রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক থেকে শুরু করে ব্যক্তির সাধারণ দ্বন্দ্বও ঘটা করে আপলোড করা হয় এসব ইউটিউব চ্যানেলে। পক্ষপাতদুষ্ট প্রতিটি কনটেন্টের জন্য সুবিধাভোগী বা স্বার্থান্বেষী মহলের কাছ থেকে নেওয়া হয় মোটা অঙ্কের টাকা। আবার চাহিদামতো টাকা না পেলে উল্টো নেতিবাচক তথ্যও আপলোড করা হয়। নিউজ বাণিজ্যের এ প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে বিভিন্ন পেশা-শ্রেণির মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসছে। এক সময়ের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী প্রতারক ইউটিউবারদের কবলে পড়ে সর্বশান্ত হওয়ার অসংখ্য নজির রয়েছে। এমনই এক ইউটিউব চ্যানেলের নাম ‘সিপ্লাস টিভি’। চট্টগ্রামভিত্তিক ইউটিউব চ্যানেল এ ‘সিপ্লাস টিভি’র প্রধান সম্পাদক হলেন আলমগীর অপু। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও প্রতারণার অসংখ্য গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। দেড় দশক আগেও আলমগীর অপু নিজেকে জাহির করতেন ছাত্রনেতা হিসেবে। চট্টগ্রাম নগরীর সিটি কলেজকেন্দ্রিক কিছু অনুষ্ঠানে তাকে দেখা যেত। তবে পদ-পদবি ছিল কি না, তা নিয়ে রয়েছে বিস্তর প্রশ্ন। ছাত্রনেতার খোলস ভেঙে এরপর তিনি নাম লেখান সাংবাদিকতায়। স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গেও এ চ্যানেলের বদৌলতে অপুর গড়ে উঠেছে গোপন সখ্যতা। আওয়ামী লীগের অনেক সৎ ও সিনিয়র নেতার চরিত্র হননের একটি মিশন নিয়েও নির্বাচনকেন্দ্রিক সামনে অগ্রসর হচ্ছে বলে জানা গেছে।

অভিযোগ উঠেছে, এ চ্যানেলে সংবাদ প্রকাশের নামে আর্থিক অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছেন অপু। এমনকি চট্টগ্রাম নগরের ওয়াসার মোড়ে যেখানে তিনি বসেন, সেটিও দখল করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অপুর হলুদ সাংবাদিকতায় বিব্রতকর ও ক্ষুব্ধ চট্টগ্রামের মূলধারার সাংবাদিকরা।

দেশের বিভিন্ন উপজেলা থেকে গ্রাম পর্যায়ে তথাকথিত সাংবাদিক নিয়োগ দিয়েছেন অপু। তাদের মাধ্যমেই চলছে টাকার লেনদেন। সে টাকায় হয়েছেন গাড়ি-বাড়ি, ফ্ল্যাটসহ নানা সম্পদের মালিক। তার দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ নগর থেকে শুরু করে উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষ।

সম্প্রতি অনলাইনভিত্তিক নিউজ পোর্টালগুলোর নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরু হলে চট্টগ্রাম থেকে কয়েকটি পোর্টাল নিবন্ধন চায়। এর মধ্যে সিপ্লাস টিভিও ছিল; কিন্তু জমি দখল, মাদকবাণিজ্য, ক্যাসিনো কান্ডে সম্পৃক্ততাসহ নানা কারণে সেটি নিবন্ধন পায়নি বলে জানা গেছে। সূত্র জানান, আলমগীর অপুর বিরুদ্ধে কর্মীদের বেতন না দেওয়া, অফিসে জুয়ার আসর বসানো, ফ্ল্যাট দখল করে অফিস বানানোসহ নানা অভিযোগ থাকার কারণে অনুমোদন দেওয়া হয়নি। 

সূত্র জানান, ব্যক্তি আলমগীর অপুর অর্থ আয়ের অন্যতম উৎস সিপ্লাসে নিউজের মাধ্যমে হয়রানি করে চাঁদাবাজি ও ক্যাসিনো ব্যবসা। আলমগীর অপুর নগরীর ওয়াসার মোড়ের র‌্যাংগস শোরুমের ১১ তলায় ক্যাসিনো টেবিল ছিল তিনটি, যেখানে র?্যাব অভিযান চালায়। এ ছাড়া দুবাই হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ পাচারের (১০ কোটি টাকা) অপরাধে এফবিআই তার বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে ও তদন্তে নামে। দুই বাংলাদেশি ও বাংলাদেশি দূতাবাসের সহযোগিতায় মুচলেকা দিয়ে (আজীবন যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা এ মর্মে) দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করেন এবং দুবাই হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন, যা ২০১৬ সালের ডিসেম্বর আমেরিকায় বাংলাদেশ অ্যাম্বেসির নথিতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

সাত বছর আগে শুরু হওয়া ‘সিপ্লাস’ নামে ইউটিউব চ্যানেলটি এখন আস্ত টাকার গাছে রূপ নিয়েছে। টাকার বিনিময়ে মুদি দোকানের ফিতা কাটা থেকে শুরু করে যে কোনো অনুষ্ঠানের খবর প্রচার করা হয় এতে। জেলা ও উপজেলা পর্যায় থেকে এভাবে টাকা দিয়ে ৯ খাতে নিউজ করানো হয় কথিত এ চ্যানেলে। সঙ্গে চাঁদাবাজির অভিযোগ তো আছেই। সিপ্লাসে যে কোনো ধরনের খবর প্রচার করতে চাইলে নির্দিষ্ট হারে টাকা দিতে হয়। যে কোনো ধরনের খেলাধুলার নিউজ, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের সংবাদ প্রচারে (উপজেলার না হলে) দিতে হয় ৫০০ টাকা করে। সব ধরনের ধর্মীয় সংবাদ, রাজনৈতিক পরিচিতি আছে কিংবা সরকারি পদ আছে, এমন কারও ব্যক্তিগত কর্মসূচির সংবাদের ক্ষেত্রে দিতে হয় ১ হাজার টাকা। রাজনৈতিক পরিচিতি নেই, এমন কারও ব্যক্তিগত কর্মসূচি, মেলার সংবাদের ক্ষেত্রে ২ হাজার টাকা এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংবাদ প্রচারে ৪ হাজার টাকা করে দিতে হয়। এ ছাড়া সংবাদের নামে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে হয়রানির অভিযোগও রয়েছে কথিত এ চ্যানেলের বিরুদ্ধে।

নিজেকে ছাত্রলীগ নেতা পরিচয় দিলেও অপুর গোটা পরিবার আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তার ভাই মুজিবুল হক মঞ্জু দুবাই বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব পদে রয়েছেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া অপুর বোন জিন্নাত রাজ্জাক চট্টগ্রাম নগর বিএনপির নেত্রী। দুই দিন আগে তিনি স্থানীয় বিএনপির এক সমাবেশে যোগ দিয়ে ফেসবুক লাইভে এসে সরকারবিরোধী নানা বক্তব্য দেন। অপুর সাম্প্রতিক লন্ডন সফর নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।

সর্বশেষ খবর