উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগ থেকে শুরু করে আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের মামলা পরিচালনায় আইন কর্মকর্তা নিয়োগ। এতদিন সবই হয়েছে দলীয় বিবেচনায়। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো সরকারই এসব পদে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়নি বলেই অভিযোগ করেছেন আইনজীবীরা। খোদ বিচারপতিদের মধ্যেও রয়েছে চাপা ক্ষোভ। সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অনেক আইনজীবী ও বিচারপতি বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ গড়ে তুলতে এবং সুপ্রিম কোর্টের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নেতাদের ভূমিকা চান তারা। এসব নিয়োগ পদ্ধতিতে চান ব্যাপক সংস্কার।
সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা এবং সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকলেও স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও তৈরি হয়নি উচ্চ আদালতে বিচারক (বিচারপতি) নিয়োগ সংক্রান্ত আইন। সদ্য বিদায়ী সরকার ২০১২ সালে আইনটি প্রণয়নের প্রথম উদ্যোগ নেয়। তারপর কেটে গেছে এক যুগের বেশি। এ সময়ে আইনটির খসড়া প্রণয়ন করা হলেও তা চূড়ান্ত হয়নি। সদ্য বিদায়ী আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বারবার আশ্বাস দিলেও এখনো খসড়াই রয়ে গেছে। জানা গেছে, উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ হয়ে আসছে ক্ষমতাসীন দলের পছন্দ অনুযায়ী। এক্ষেত্রে সংবিধানে থাকা ১০ বছরের অভিজ্ঞতার বাধ্যবাধকতা পূরণ করে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও অধস্তন আদালতের বিচারকদের মধ্য থেকে নিয়োগ দেওয়া হয় বিচারপতিদের। তবে অনেক সময়ই ১০ বছরের অভিজ্ঞতার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা পূরণ না করার অভিযোগ পাওয়া যায়। এদিকে সংবিধানে শুধু অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগের বিষয়ে অনুচ্ছেদ থাকলেও রাষ্ট্রপক্ষের অন্য আইনজীবী নিয়োগের বিষয়ে কিছু বলা নেই। নেই এ সংক্রান্ত কোনো আইন। উচ্চ ও নিম্ন আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী নিয়োগে স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠন জরুরি হলেও নানা জটিলতায় এ সংক্রান্ত আইন আটকে আছে ১৬ বছর। সরকার প্রধান, আইনমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী আইনজীবী নেতাদের সন্তুষ্টি সাপেক্ষে বর্তমানে এসব পদে নিয়োগ পান প্রত্যাশী আইনজীবীরা। অনেক সময়ই পাওয়া যায় অর্থনৈতিক লেনদেনের অভিযোগ। উচ্চ আদালতে অ্যাটর্নি জেনারেলের পর অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলরা রাষ্ট্রপক্ষের মামলায় লড়েন। অধস্তন আদালতে লড়েন পাবলিক প্রসিকিউটর, স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটররা, সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটরা। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতার পরিবর্তে শুধু দলীয় আনুগত্য হয় তাদের নিয়োগের প্রধান শর্ত। এসব নিয়োগে লাগে না কোনো বিজ্ঞপ্তি বা পরীক্ষা। আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিগত ২০০২ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের চূড়ান্ত অনুমোদনের পর অ্যাটর্নি সার্ভিস অধ্যাদেশ সংবিধানের ৯৩(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী একই বছরের ১৫ মে অনুমোদন দেন রাষ্ট্রপতি। এর তিন দিন পর ১৮ মে গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। ওই অধ্যাদেশের ক্ষমতাবলে একই বছর ২ জুন সরকারি অ্যাটর্নি অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর সংসদে অনুমোদন না হওয়ায় আলোর মুখ দেখেনি বিচার কার্যক্রমের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস আইন’। এদিকে স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিসের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে উচ্চ আদালতে একাধিক রিট হলেও সুফল মেলেনি। জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি এ বি এম ওয়ালিউর রহমান খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিচারপতিদের আদালতে না আসা প্রমাণ করে, তারা দলীয় বিচারপতি। তিনি বলেন, এখন এটা প্রমাণিত বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ দলীয় বিবেচনায় চালিয়েছে সদ্য বিদায়ী সরকার। প্রধান বিচারপতি থেকে শুরু করে আপিল বিভাগের সব বিচারপতি দলীয় ভাবেই নিয়োগ পেয়েছেন। দলীয় এজেন্ডা নিয়েই তারা বেশি কাজ করেছেন। বিচার বিভাগকে রাজনীতিকীকরণ করায় এখন সাধারণ মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে। এ সংকটের উত্তরণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, সংবিধানে বা আইনের মাধ্যমে পেশাজীবী রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। আমি যখন আইনজীবী সমিতির নির্বাচিত নেতা ছিলাম, তখনো এ কথা বলেছিলাম। পেশাজীবীরা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত হওয়ার কারণে এই সমস্যাগুলো হচ্ছে। ভবিষ্যতের সংকট কাটাতে মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে দ্রুত ‘বিচারপতি নিয়োগ আইন’ ও ‘স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস আইন’ প্রণয়ন করতে হবে।
ছাত্র নেতৃত্বের উদ্দেশে বিচারপতির ফেসবুক স্ট্যাটাস : স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ গড়ে তুলতে এবং সুপ্রিম কোর্টের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে ছাত্র নেতৃত্বকে কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগের বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ। নিজের এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি এসব পরামর্শ দেন। স্ট্যাটাসে বিচারপতি হাসান আরিফ লিখেছেন, ‘বিচারপ্রার্থী মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট দলীয় রাজনীতির জাঁতাকলে পড়ে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্নভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। বর্তমানে কোনো দলীয় সরকার নেই। তাই নতুন বাংলাদেশের কারিগর, সন্তানতুল্য ছাত্রছাত্রীদের জন্য দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে সুপ্রিম কোর্টের একজন জ্যেষ্ঠ বিচারক হিসেবে কথাগুলো বলা আমার নৈতিক দায়িত্ব মনে করছি। নি¤েœ বর্ণিত কাজগুলো বাস্তবায়িত না হলে সুপ্রিম কোর্ট সবসময় বিতর্কিতই থেকে যাবে এবং তোমাদের স্বপ্নের দেশ গঠনে বড় বাধা হয়ে থাকবে বলে মনে করি।
কাজগুলো নিম্নরূপ- ‘১) বিচারপতি নিয়োগে দল-নিরপেক্ষ আইন প্রণয়ন করা। ২) হাই কোর্ট বিভাগের বেঞ্চ গঠনে প্রধান বিচারপতির একচ্ছত্র ক্ষমতায় চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের ব্যবস্থা রাখা। ৩) হাই কোর্ট বিভাগের জি এ কমিটি এবং জাজেজ কমিটি গঠনে প্রধান বিচারপতির একচ্ছত্র ক্ষমতায় লাগাম টানা। ৪) হাই কোর্ট বিভাগের বিচারকদের পারস্পরিক জ্যেষ্ঠতার ব্যত্যয় ঘটিয়ে আপিল বিভাগে নিয়োগ সাংবিধানিকভাবে বন্ধ করা। ৫) একই ভাবে আপিল বিভাগের বিচারকদের পারস্পরিক জ্যেষ্ঠতার ব্যত্যয় ঘটিয়ে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ সাংবিধানিক ভাবে বন্ধ করা। ৬) বিচারকদের দুর্নীতি ও পক্ষপাতমূলক আচরণ বন্ধে বিচারক এবং সাংসদদের সমন্বয়ে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক সাংবিধানিক পদ্ধতি প্রণয়ন করা।’ ফেসবুক পোস্টে ছাত্রদের উদ্দেশে লিখেছেন, ‘মনে রাখবা, বিচারপতিরা আসমান থেকে নেমে আসে না। তোমাদের অগ্রজদেরই কেউ কেউ বিচারপতি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়।’