‘ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থান চলাকালে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের গুলিবিদ্ধ লাশ ভ্যানের ওপর স্তূপ করে রাখছে পুলিশ। ভ্যানের নিচে জমাট বেঁধে আছে লাশের শরীর থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত। লাশগুলো ঢেকে দিচ্ছে ময়লা চাদর ও রাস্তার পাশে পড়ে থাকা পরিত্যক্ত ব্যানার দিয়ে।’ গত ৫ আগস্ট ঢাকার অদূরে আশুলিয়ায় ঘটে যাওয়া বীভৎস ও রোমহর্ষক এই ভাইরাল ভিডিওতে থাকা আরও এক পুলিশ সদস্যকে শনাক্ত করা হয়েছে। এ ঘটনা তদন্তে গঠন করা হয়েছে অ্যাডিশনাল এসপি ও ডিএসবি কর্মকর্তার সমন্বয়ে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি। ভিডিওতে দেখা যায়, লাশ যখন ভ্যানে তোলা হচ্ছে তখন পাশ দিয়ে চিন্তিত মুখে পায়চারি করছেন দুই পুলিশ সদস্য। তাদের মধ্যে একজন ঢাকা জেলা উত্তর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) আরাফাত হোসেন, তার পরনে ছিল পুলিশের ভেস্ট ও হাতে হেলমেট। আর টিশার্ট পরিহিত আরেকজন হলেন কনস্টেবল রেজাউল করিম। গতকাল স্থানীয়রা ভিডিওতে দেখতে পাওয়া রেজাউলের পরিচয় নিশ্চিত করেছেন। এ ছাড়া গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র রেজাউল করিমের পরিচয় শনাক্ত করেছেন। তিনি ঢাকা উত্তর গোয়েন্দা পুলিশের কনস্টেবল। তার গ্রামের বাড়ি বরিশালে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর গোয়েন্দা পুলিশের ইনচার্জ রিয়াজ আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের ঢাকা জেলা উত্তর গোয়েন্দা পুলিশ রেজাউল নামে একজন কনস্টেবল কর্মরত রয়েছেন। তবে ভিডিওতে দেখতে পাওয়া ওই ব্যক্তি তিনি কি না তা আমি নিশ্চিত নই। রেজাউল এখন ছুটিতে রয়েছেন। গত ৫ আগস্ট রেজাউল কোথায় ডিউটি করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, রেজাউল কোথায় ডিউটি করেছেন, তা তিনি নিশ্চিত নন। এদিকে ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানে পুলিশ বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার একটি প্রমাণ ১ মিনিট ১৪ সেকেন্ডের এই ভিডিওর ঘটনা তদন্তে অ্যাডিশনাল এসপি ও ডিএসবি কর্মকর্তার সমন্বয়ে চার সদস্যদের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে আশুলিয়া থানা পরিদর্শন শেষে এ তথ্য নিশ্চিত করেন ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার আহম্মদ মুঈদ।
পুলিশ সুপার বলেন, যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে সেটি আমাদের নজরে এসেছে। আমাদের জায়গা থেকে যা করণীয় তা আমরা করছি। ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা তদন্ত করছেন। আমরা সবার সহযোগিতা পেয়েছি। কারা কারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত, কারা উপস্থিত ছিলেন। আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য নামগুলো প্রকাশ করছি না। খুব শিগগিরই আপনাদের সামনে তা প্রকাশ করা হবে।
আহম্মদ মুঈদ বলেন, যেগুলো ভিডিওতে এসেছে সেগুলো দেখেছি, তবে ফিজিক্যাল এভিডেন্স এখনো পাইনি। এগুলো নিয়েও আমাদের কাজ চলছে। শনিবার একটি নিখোঁজ ডায়েরি হয়েছে। আমরা এটি নিয়েও কাজ করছি। আশা করছি, খুব ভালো একটা রেজাল্ট আসবে। জড়িত পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা হবে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যে অপরাধী সে যেই হোক তার নামে মামলা হবে। পুলিশ আইনের বাইরে নয়। তিনি আরও বলেন, শুধু ছাত্র-জনতা না, আমাদের অনেক পুলিশ সদস্যকেও আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। পুলিশ হত্যার মামলাও হবে। প্রধান উপদেষ্টার সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে মানবাধিকার লঙ্ঘন হলে গুরুত্বের সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর আগে গত ২৯ আগস্ট রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভ্যানে লাশের স্তূপের এই ভিডিওটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, দুজন পুলিশ সদস্যের একজন হাত ও একজন পা ধরে চ্যাংদোলা করে ভ্যানে লাশের স্তূপের ওপর নিক্ষেপ করছেন। সর্বশেষ লাশটি তুলে একটি পরিত্যক্ত ব্যানার দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। শেষে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতি দেখা যায়। ভিডিওর ১ মিনিট ৬ সেকেন্ডে একটি পোস্টার দেখা যায়, যা স্থানীয় যুবলীগের ধামসোনা ইউনিয়ন সভাপতি প্রার্থী ও ধামসোনা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার প্রার্থী আবুল হোসেনের। সেই পোস্টারটি দেখে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, ভিডিওটির ঘটনাস্থল আশুলিয়া থানার সামনেই।
প্রসঙ্গত, ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থান চলাকালে গত ৫ আগস্ট ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বাইপাইল এলাকায় জমায়েত হতে থাকেন আন্দোলনকারীরা। পরে শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের খবরে আন্দোলনকারীরা আশুলিয়া থানার দিকে অগ্রসর হয়। এ সময় পুলিশ আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এ ঘটনায় সেদিন আশুলিয়ায় ১৫ জনের মৃত্যু হয় (ভ্যানে তোলা লাশের হিসাব বাদে)।