অনিশ্চয়তা কাটছে না উচ্চশিক্ষায় ইউরোপ গমনেচ্ছু বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই ভারতীয় ভিসা জটিলতায় দিল্লিতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসে সাক্ষাৎকারে অংশ নিতে পারছেন না তারা। এতে অনিশ্চিত হয়ে গেছে অনেকের উচ্চশিক্ষা। আবার কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফি জমা দিয়ে তা ফেরত না পাওয়ার শঙ্কায় আছেন। বর্তমান সরকার কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে কয়েকটি দেশের ভিসা বিকল্প দেশ থেকে সংগ্রহের ব্যবস্থা করলেও অধিকাংশ দেশের ক্ষেত্রেই এখনো কোনো সুখবর নেই। এ নিয়ে সরকারের তরফ থেকেও খোলাসা করে কিছু বলা হচ্ছে না।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে ভিসা সেন্টার দিল্লি থেকে সরিয়ে ঢাকায় অথবা প্রতিবেশী কোনো দেশে স্থানান্তরের অনুরোধ জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চলছে। এরই মধ্যে ভারতের বিকল্প দেশ হিসেবে ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, নেপাল ও পাকিস্তান থেকে কাজাখস্তান, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া ও ক্রোয়েশিয়ার ভিসা সংগ্রহের ব্যবস্থা হয়েছে। মেক্সিকান ভিসার আবেদন নয়াদিল্লির পরিবর্তে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের যে কোনো মেক্সিকান দূতাবাস বা কনস্যুলেটে জমা দেওয়া যাচ্ছে। আগামী বছরের শুরুতে ক্রোয়েশিয়া ও বুলগেরিয়ার ভিসা আবেদন বাংলাদেশ থেকেই করা যাবে। অন্য দেশগুলোর বিষয়টা এখনো অনিশ্চিত। সূত্র জানায়, ঢাকায় অবস্থিত ৫১টি দূতাবাসের মধ্যে ইউরোপের ১৩টি দেশের দূতাবাস রয়েছে। তবে পর্তুগাল, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, ফিনল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া, কাজাখস্তান, অস্ট্রিয়া, চেক রিপাবলিক, নর্থ মেসিডোনিয়া, পোল্যান্ড, স্লোভেনিয়া, লুক্সেমবার্গ, বেলজিয়াম, আইসল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, মেক্সিকো, গ্রিসসহ ইউরোপের অধিকাংশ দেশের দূতাবাস বাংলাদেশে নেই। এসব দেশে পড়তে যেতে চাইলে শিক্ষার্থীদের নিকটবর্তী দেশ ভারতে ভিসা সাক্ষাৎকার দিতে হয়। ভারত ভিসা সীমিত করায় অনেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের অফার লেটার পেয়েও টিউশন ফি জমা দিচ্ছেন না। ফিনল্যান্ডের কারেলিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে অফার লেটার পাওয়া সাকিব ইসলাম বলেন, এক সপ্তাহ আগেই ভিএফএস অ্যাপয়েন্টমেন্ট অ্যাভেইলেবল বলে মেইল এসেছে। ভারতের ভিসা পাব কি না এ আশঙ্কায় অ্যাপয়েন্ট বুক করিনি। টিউশন ফিও জমা দিইনি। জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করে দেখি। মোকাররম হোসেন বলেন, ভারতের ভিসা না হওয়ায় একবার অ্যাপয়েন্টমেন্ট মিস করেছি। আবার ভিসার জন্য কাগজপত্র জমা দিয়েছি। নরসিংদীর সাগর সরকার জানান, দিল্লিতে ফিনল্যান্ড অ্যাম্বাসি ফেস করার জন্য তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ৯ জানুয়ারি। এখনো ভারতের ভিসা পাননি। শিক্ষার্থীরা বলছেন, দেশ স্বাধীনের ৫৩ বছর পরও ইউরোপের অধিকাংশ দেশের ভিসা সেন্টার হয়নি বাংলাদেশে। ফলে ইউরোপের ভিসার জন্য মোটা টাকা খরচ করে পাড়ি দিতে হয় ভারতে। আগস্ট থেকে ভারত ভিসা সীমিত করায় টাকা খরচ করেও সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসে গিয়ে ভিসা সাক্ষাৎকার দেওয়া যাচ্ছে না। ফিনল্যান্ডে বসবাসকারী জাকির হোসেন (ফিনল্যান্ডগামী শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিং করেন) বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এবারও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আগের বছরের মতোই বাংলাদেশি শিক্ষার্থী অ্যাডমিশন নিয়েছেন। তবে ভিসা জটিলতায় অধিকাংশই এখনো আসতে পারেননি। অনেকের পরিবারসহ আসার কথা। শিক্ষার্থী আগস্টে চলে এসেছেন। পরিবারের অন্য সদস্যরা আসতে পারেননি। তিনি বলেন, আগস্ট থেকে বাংলাদেশে ভারতীয় ভিসা সেন্টারগুলোয় ডাবল এন্ট্রি ভিসার আবেদন জমা নিচ্ছে না। শুধু ভারতীয় হাইকমিশন সীমিত সংখ্যক আবেদন নিচ্ছে। সেখান থেকে লটারির মতো করে দু-একজনকে ভিসা দিচ্ছে। এ সুযোগে ভারতের ভিসা করিয়ে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন এজেন্সি জনপ্রতি ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা নিচ্ছে বলে অনেকেই জানিয়েছেন।
এদিকে গত ১০ ডিসেম্বর থেকে ভিএফএস গ্লোবালের সহযোগিতায় বেলজিয়াম, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, লাটভিয়া, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড, স্লোভেনিয়া বা সুইডেন যেতে ভিসা আবেদনের জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট পদ্ধতি চালুর ঘোষণা দেয় ঢাকায় অবস্থিত সুইডিশ দূতাবাস। এতে অনেকেই ধারণা করেন বাংলাদেশে বসেই দেশগুলোর সব ভিসা মিলবে। এ ব্যাপারে সুইডিশ দূতাবাসে যোগাযোগ করলে জানানো হয়, তারা শুধু স্বল্পমেয়াদি শেনজেন ট্যুরিস্ট ভিসার আবেদন গ্রহণ করছেন। শিক্ষার্থী, বসবাসের অনুমতি বা কাজের ভিসার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসে যোগাযোগ করতে হবে। অন্যদিকে ফিনল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, পর্তুগাল, গ্রিসের ভিসার জন্য দিল্লিতে সশরীরে উপস্থিত না হয়ে বিকল্প উপায়ে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করতে বাংলাদেশের পক্ষে বারবার অনুরোধ করলেও দেশগুলো অপারগতা প্রকাশ করেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনকূটনীতি বিভাগের মহাপরিচালক মোহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, দেশগুলো তাদের অভিবাসনসংশ্লিষ্ট আইনের বরাত দিয়ে নয়াদিল্লিতে অবস্থিত দূতাবাসে সশরীরে উপস্থিতি ছাড়া বিকল্পের বিষয়ে অপারগতা প্রকাশ করেছে। এমন পরিস্থিতিতে অর্থ অপচয় ও ভোগান্তি কমাতে ইউরোপীয় দেশগুলোর দূতাবাস অথবা কনস্যুলেট বাংলাদেশে স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। গত মাসে এ দাবিতে রাজধানীতে মানববন্ধন করে ইউরোপ গমনেচ্ছু ভিসাপ্রত্যাশী ঐক্য পরিষদ। শিগগিরই বিষয়টা নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করবেন বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির সভাপতি নাফিসা ইসলাম খান। এ ব্যাপারে সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছিলেন, বিষয়টা সমাধানে সরকার সর্বোচ্চ আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করছে। আশা করছি শিগগিরই এ সংকটের সমাধান হবে।