ভোর হওয়ার আগেই হাসিনা বেগমের কাজ শুরু হয়। রান্না, বাচ্চাদের নাশতা, বৃদ্ধ শাশুড়ির ওষুধ-সব শেষ করে তবেই একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ পান তিনি। বাংলাদেশের অগণিত নারীর মতো হাসিনার দিনও চলে বিনা মজুরির কাজে। অথচ এই শ্রম পরিবার ও সমাজকে টিকিয়ে রাখলেও অর্থনীতির পাতায় তার অস্তিত্ব নেই।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সম্প্রতি তার এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানায়, দেশের নারীরা গৃহস্থালি ও সেবাযত্নের জন্য মজুরি পেলে বছরে সেই অঙ্ক দাঁড়াত প্রায় ৫ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। রান্না ও ঘরের কাজের মূল্য প্রায় ৩ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা, আর শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থদের যত্নের মূল্য প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। পুরুষদের সীমিত অবৈতনিক কাজ যোগ করলে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াত ৬ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি মূল্যে জিডিপির প্রায় ১৬ শতাংশ। নারীরা দিনে গড়ে প্রায় ছয় ঘণ্টা মজুরিহীন কাজ করেন, যা পুরুষদের সময়ের সাত গুণের বেশি। বছরের হিসাবে গড় নারী-পুরুষ উভয়ই অবৈতনিক কাজ করেন ২ হাজার ৪৩৫ ঘণ্টা, যার ৮৮ শতাংশ নারীর ঘাড়ে পড়ে। রান্নার কাজেই লাগে ১ হাজার ২০০ ঘণ্টার বেশি, বাচ্চাদের যত্নে ৪২০ ঘণ্টা, আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় ২৩৭ ঘণ্টা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এসব পরিসংখ্যান অনুযায়ী নারীর অদৃশ্য শ্রম শুধু পরিবারের নয়, দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। এই অঙ্ক শুধু অর্থনৈতিক হিসাব নয়, এটি দেশের উন্নয়ন ভাবনার দিকনির্দেশক। যদি এই শ্রম স্বীকৃতি না পায়, তাহলে নীতি নির্ধারণ ও বাজেটে অর্ধেক জনগোষ্ঠীর অবদান অদৃশ্য থেকে যাবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অবৈতনিক কাজের স্বীকৃতি সামাজিক মানসিকতায় পরিবর্তন আনবে এবং পুরুষদেরও পরিবারে দায়িত্ব ভাগাভাগি করতে উৎসাহিত করবে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাংলাদেশে নারীরা যেসব গৃহস্থালি কাজ, সন্তান ও পরিবার যত্ন, অভ্যন্তরীণ পরিচর্যা, রান্না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি বিনা মজুরিতে করছেন, তার অর্থনৈতিক মূল্য বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় এক-দুই ভাগের সমপরিমাণ হতে পারে, যা দেখায় যে নারীদের অবদানের গুরুত্ব কত বড়। সহজভাবে বলতে গেলে, এটি দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদানকে উপেক্ষা করা হচ্ছে, যা সরকারি হিসাব বা জিডিপিতে প্রকাশিত হয় না। কিন্তু এর মূল্য অনেক। অর্থাৎ, নারীর ‘অদৃশ্য শ্রম’ দেশের অর্থনীতির জন্য বিশাল অবদান রাখছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘নারীর অবদানকে যদি স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তাহলে নীতি-নির্ধারণকারীরা সামাজিক সেবা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে আরও বাস্তবভিত্তিক বাজেট ও কর্মসূচি তৈরি করতে পারবেন। তা ছাড়া অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে স্বীকৃতি পেলে নারীর অবদান সমাজে আরও সম্মানজনক হবে এবং লিঙ্গবৈষম্য হ্রাস পাবে। এতে পরিবারে এবং সমাজে নারীর মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন পাওয়ার ফলে নারীরা আত্মমর্যাদা অনুভব করবেন, যা মানসিক ও সামাজিক সুস্থতার জন্য সহায়ক।’
অর্থনীতিবিদরা জানান, কানাডা ও নিউজিল্যান্ডে ‘হাউসহোল্ড স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট’ তৈরি করে নারীর গৃহস্থালি কাজের অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইনসে সরকারি রিপোর্টে নারী শ্রমের অবদানকে পরিমাপ করা হয় এবং নীতি-নির্ধারণে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সুইডেন ও নরওয়েতে গৃহকর্মকে সামাজিক সেবা হিসেবে গণনা করা হয় এবং বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এই ধরনের উদ্ভাবন থেকে বাংলাদেশও শিক্ষণীয় দিক নিতে পারে। সরকার নিয়মিত গৃহস্থালি ও যত্নমূলক কাজের সময় পরিমাপ করে তার অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণ করতে পারে। পরিবার এবং সমাজে নারীর এই শ্রমকে সম্মানজনক ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সচেতনতা ও প্রচার বাড়াতে পারে। অর্থনীতিবিদ ফাহমিদা খাতুন বলেন, নীতি ও সামাজিক সেবায় নারীর কাজকে অন্তর্ভুক্ত করলে নারীর জন্য আরও প্রশিক্ষণ, সুবিধা ও সমান সুযোগ তৈরি হবে। বৈশ্বিক অভিজ্ঞতাও প্রমাণ করে যে, নারীর অদৃশ্য শ্রমকে স্বীকৃতি দিলে দেশের অর্থনীতি ও সমাজে বড় সুবিধা হয়।