শুভ আগামীর প্রত্যয়ে দেবী দুর্গার প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হলো এবারের শারদ উৎসব। রাজধানীতে বিজয়াদশমী উদ্যাপন শেষে কড়া নিরাপত্তায় বুড়িগঙ্গা নদীতে প্রতিমা বিসর্জন দিয়েছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। বিজয়াদশমীতে সিঁধুর খেলা এবং দেবী দুর্গাকে বিসর্জনের মাধ্যমে শেষ হয় দুর্গোৎসবের মূল আনুষ্ঠানিকতা। পঞ্চম দিনে মর্ত্যলোক থেকে বিদায় নিয়েছেন দেবী দুর্গা।
আসছে বছর আবার হবে দেবী দুর্গার আগমন। সজল নয়নে দেবীকে বিদায় দিয়ে শুভ আগামীর বার্তা পায় ভক্তরা। গতকাল বেলা ৩টা ২৪ মিনিটের মধ্যে দেবী দুর্গার দশমী বিহিত পূজা এবং দর্পণ বিসর্জন করা হয়। এরপর দেবী দুর্গার পায়ে সিঁদুর ছুঁইয়ে নেন সধবা সনাতন ধর্মাবলম্বী নারীরা। সারা বছর নিজের সিঁথির সিঁদুর সুরক্ষিত রাখতে দেবী মার আশীর্বাদ প্রার্থরা করেন তারা। এরপর চলে সিঁদুর খেলার ধুম। পরিচিত-অপরিচিতর বন্ধন ভুলে সর্বজনীন উৎসব পূর্ণতা পায় সিঁদুর খেলায়। রঙের হুল্লোড়ে ভাসিয়ে বিদায় নেন দেবী দুর্গা। পূজা শেষে মহিষাসুর মোর্দিনী দেবী দুর্গার আশীর্বাদে সব বাধাবিপত্তি পেরিয়ে যেতে পরিবারের সবাই ধারণ করেন অপরাজিতা।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, গতকাল বিকাল সাড়ে তিনটা থেকে পুরান ঢাকার সদরঘাট বুড়িগঙ্গা নদীর বিনা স্মৃতি শ্মশান ঘাটে ধানমন্ডি মণ্ডপের প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় আয়োজন। একই সঙ্গে ওয়াইজঘাট, তেলঘাটসহ বুড়িগঙ্গা নদীর তিন ঘাটে প্রতিমা বিসর্জন হয়েছে। দেবী দুর্গাসহ অন্যান্য দেব-দেবীকে ঢাকঢোল, খোল-করতাল, শঙ্খ, উলুধ্বনি সহযোগে শোভাযাত্রাসহ সদরঘাটের বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বিসর্জনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক বিদায় জানানো হয়। মূলত দর্পণ বিসর্জনের মধ্য দিয়েই শেষ হয় দুর্গাপূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা।
এদিন বিকাল থেকেই ঢাকার বিভিন্ন পূজামণ্ডপ থেকে প্রতিমা আসতে থাকে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে বিনা স্মৃতি শ্মশানঘাটসহ আশপাশের ঘাটে। ঢাকের তালে নেচে-গেয়ে প্রতিমা নিয়ে আসেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। বিষাদ-আনন্দ এক করে দেবী দুর্গাকে বিসর্জন দেন বক্তারা। প্রতিমা বিসর্জনকে ঘিরে তৎপর ছিল সেনাবাহিনীসহ কয়েক স্তরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এর মধ্যে পুলিশ, র?্যাব, নৌ-পুলিশ, বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, ক্রাইম সিন টিম, সোয়াট দলের সদস্য ও সাদা পোশাকসহ বিভিন্ন বাহিনীর দায়িত্বরত ব্যক্তিদের কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যায়। মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি জয়ন্ত কুমার দেব বলেন, দশমী পূজা শেষে বিকাল ৩টায় ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে বের হয় মূল শোভাযাত্রা। পরে নগরীর ওয়াইজঘাট, তুরাগ, ডেমরা, পোস্তগোলা ঘাটে শুরু হয় প্রতিমা বিসর্জন। বিভিন্ন মণ্ডপ প্রতিমা বিসর্জনের জন্য মূল শোভাযাত্রায় যুক্ত হয়। এ বছর সারা দেশে ৩৩ হাজার ৩৫৫টি মণ্ডপ ও মন্দিরে শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতে রয়েছে ২৫৯টি পূজামণ্ডপ।’
এর আগে দুপুর দুইটা থেকে রাজধানীর বিভিন্ন পূজামণ্ডপ থেকে শঙ্খ আর উলুধ্বনি, খোল-করতাল-ঢাকঢোলের বাজনার সঙ্গে দেবী বন্দনার গানের মধ্যদিয়ে প্রতিমা নিয়ে শোভাযাত্রা বের করার আগে নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিমা জড়ো হতে থাকে ঢাকেশ্বরী মন্দির প্রাঙ্গণ ও পলাশী মোড়ে। পরে পুরান ঢাকার বিভিন্ন সড়ক ঘুরে বুড়িগঙ্গার তীরে এসে শেষ হয় এ শোভাযাত্রা। এ সময় বুড়িগঙ্গা তীরের বিনা স্মৃতি শ্মশানঘাটে আসেন পুণ্যার্থীরা। ঢাকার বিভিন্ন পূজা উদ্যাপন পরিষদের হাজারো মানুষের শোভাযাত্রা নিয়ে বুড়িগঙ্গা তীরে জড়ো হন দেবী ভক্তরা।
বাদ্য বাজনা বাজিয়ে দুর্গাভক্তরা দেবীবন্দনার গান গেয়ে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে বুড়িগঙ্গার ঘাটে নিয়ে যায় দেবী দুর্গাকে। রাজধানীর অধিকাংশ মণ্ডপের প্রতিমা বিসর্জন হয় সদরঘাট বুড়িগঙ্গা নদীতে। প্রতিমা ঘাটে নিয়ে আসার পর শেষবারের মতো ধূপধুনো নিয়ে আরতিতে মেতে ওঠেন ভক্তরা। শেষে পুরোহিতের মন্ত্রপাঠের মধ্যদিয়ে দেবীকে নৌকায় তুলে বিসর্জন দেওয়া হয়। বিসর্জনের এ পর্ব রাত পর্যন্ত চলে। শাস্ত্রমতে, এ বছর দেবীর মর্ত্যে আগমন ঘটেছিল গজ বা হাতিতে এবং দেবী দেবী দুর্গা দোলা বা পালকিতে কৈলাসে গমন করেন। এ ধরনের গমনের ফলস্বরূপ মহামারি, ভূমিকম্প এবং অতিমৃত্যুর মতো দুর্যোগ দেখা দিতে পারে বলে শাস্ত্রে উল্লেখ আছে। এবার রাজধানীর ২৫৪টি পূজামণ্ডপের প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয় বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও বালু নদীর ১০টি ঘাটে।